সব ডেঙ্গু রোগীকেই কি হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে?
নেক্সাস টেলিভিশনের বিশেষ টকশো ‘কেমন আছেন’। বিষয় : সব ডেঙ্গুরোগী কি হাসপাতালে ভর্তি হবে? ডেঙ্গু রোগীদের করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এবিএম সফিউল্লাহ কবির।। বিএসএমএমইউর শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আফরোজা বেগম।
শ্রæতিলিখন : জান্নাতুল ফেরদৌস
ডা. এবিএম সফিউল্লাহ কবির, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল: সব ডেঙ্গু রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় রোগীর পরিবারের লোকজনদের রোগীকে নিয়ে অতি উদ্বিগ্নতার ফলে আমাদের রোগী ভর্তি করতে হয় কারণ তা না হলে বাড়িতে থেকে তারা রোগীর এবং তাদের পরিবেশ পরিস্থিতি নষ্ট করে ফেলবে। কোনো লক্ষণ ছাড়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শতকরা ৮০ ভাগ। বাকি ২০ ভাগকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায় মৃদু, মধ্য এবং তীব্র। শেষের তীব্র ৫ ভাগ আমাদের টেনশনের বিষয়। এই ৫ ভাগ রোগীদের মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। এর মধ্যে ছোট বাচ্চারা এবং অনেক বয়স্ক যারা আছে, যাদের হার্টে সমস্যা আছে, কিডনি ডিজিজ আছে, ক্যান্সারের রোগী, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগী তারা মৃত্যু ঝুঁকিতে বেশি থাকে। তাদের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নেয়া হলে সেক্ষেত্রে এসকল রোগীকে আইসিও পর্যন্ত নেয়া লাগে। আগে রোগীরা আসতো হাড়ভাঙা জ্বর নিয়ে কিন্তু এখন রোগীরা আসে ডায়রিয়া নিয়ে, শরীর ব্যাথার মাত্রা কম, জ্বর কম কিন্তু টেস্ট করলে দেখা যায় ডেঙ্গু পজিটিভ। সব রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই; যাদের প্রয়োজন নেই তাদের আমরা বুঝিয়ে বলি বাসায় বিশ্রাম নেয়ার জন্য কারণ বিশ্রাম নিলে রক্তে প্লাটিলেট যদি কমে যায় সেটা অত্যন্ত দ্রæত বেড়ে যাবে। এছাড়া ডিহাইড্রেশন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে তাই আমরা বিশ্রামের পরামর্শ দেই। তাদেরকে আমরা তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে বলি।
দৈনিক ৭ থেকে ১০ গøাস পানি খেতে হবে যা পরিমাপ করলে ২ থেকে আড়াই লিটার পানি হয়। জ্বরের সাথে শরীর থেকে আরও কিছু পানি বাষ্প হয়ে যায় তাই তাকে আরও ৫০০ মি.লি বেশি পানি খেতে হবে। তবে আবার অতিরিক্ত পানি খাওয়া যাবে না তাতে বমি হতে পারে বমি পর্যন্ত এটি নেওয়া
যাবে না কারণ বমি হলে আবার আরেক বিপদ। ডেঙ্গুকে যদি আমরা তিন ভাগে ভাগ করি তাহলে প্রথমটি হলো ফেভরাইল বা জ্বর যা এক সপ্তাহ থাকে এখানে যতো রকম জটিলতা থাকে তাকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল ফেজ এর মেয়াদ হলো ২৪ ঘন্টা থেকে ৪৮ ঘন্টা বা কোথাও কোথাও আছে ৭২ ঘন্টা। এই ফেজে জ্বর থাকে না, ভাইরাস থাকে না কিন্তু সব ধরনের জটিলতা এই সময়ের মধ্যে দেখা দেয়। এই ফেজ আমরা পার করতে পারলেই আসবে রিকোভারি ফেজ। কেনো রকমের বিপদ সংকেত দেখা দিলে ঘরে থাকার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা বলবো যাদের ভর্তি হওয়া দরকার তারাই ভর্তি হবেন যাদের দরকার নেই তারা চাপাচাপি করে ভর্তি হবেন না কারণ এতে করে যারা মুমূর্ষ রোগী তারা ভর্তির জন্য সিট পান না।
অধ্যাপক ডা. আফরোজা বেগম, শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ, বিএসএমএমইউ: ডেঙ্গু বর্তমানে একটি আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেঙ্গু হলেই হাসাপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই। ডেঙ্গু যখন প্রথম বারের মতো আক্রন্ত হয় তখন এটি একটি ভাইরাল ফিবারের মতো হয় যা তিন চার দিন পর সেরে যায়। আমাদের কিছু বিপদ সংকেত আছে যেগুলো বাবা-মাকে জানানো প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। বাচ্চাকে প্রথমেই প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো দিতে হবে যেমন পানি খাওয়ানো, বুকের দুধ খাওয়ানো, ডাবের পানি খাওয়ানো। অভিভাবকদের বলতে হবে বাসায় থাকেন ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে কিছু বিপদ সংকেত আছে যেমন বাচ্চা যদি খুব বেশি অস্থির হয়ে যায়, পেট ব্যাথা করে, পেট বা মুখ যদি ফোলা ফোলা লাগে, বাচ্চার যদি প্র¯্রাব কমে যায় তাহলে বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
আমাদের ধারণা ডেঙ্গু মানে শুধু জ্বর কিন্তু না ডেঙ্গু হলে জ্বরের সাথে সর্দি-কাশি, পাতলা-পায়খানা, বমি এগুলো হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া লাগবে। তার পালস, বøাড প্রেসার দেখতে হবে। বøাড কাউন্টে আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে তা হলো প্লাটিলেট কমে গেলেই হয়তো রোগী মরে যাবে তাকে হয়তো প্লাটিলেট দিতে হবে। আসলে তা নয় এখানে এতো ভয়ের কিছু নেই প্লাটিলেট ১০ হাজার বা ২০ হাজারে নেমে গেলেও কিছু হয়না আমাদের দেখতে হবে পানিশূন্যতার কি অবস্থা কারণ বাচ্চাদের হিমোডায়নামিক বড়দের চেয়ে ভিন্ন। খুব তাড়াতাড়ি তারা পানিশূন্যতার দিকে চলে যায়। এই বিপদসংকেতগুলো দেখা দিলে আমাদের সিভিসি করে দেখতে হবে রক্তের হিমাটোক্রিক অর্থাৎ রক্তের ঘনত্বের কি অবস্থা এটি দেখে যদি বাচ্চাকে মুখে খাবার দিতে পারে তাহলে ভালো নাহলে আইভি ফ্লুইট দিতে হবে। এটি হলো বড়দের সাথে বাচ্চাদের পার্থক্য। মশা বাচ্চাদের বেশি কামড়ায় বড়দের কম এটি আমি কোথাও পাইনি তবে বাচ্চারা যখন ঘুমায় বা খেলা করে তারা মশা তাড়াতে পারে না তাই হয়তো বাচ্চাদের বেশি কামড়ায়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জ্বর, কান্নাকাটি, বমি এগুলোর প্রভাব বেশি থাকে।
আমাদের ডাক্তারদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব হলো বাচ্চার অভিবাবকদের বুঝিয়ে বলা যাতে তারা অতি উদ্বিগ্ন না হয়ে যায়। ডেঙ্গু হওয়া মানেই বাচ্চা শকে চলে যাবে তা নয়। বাচ্চা ঠিকভাবে পানি খায় কিনা আমরা দেখি কিন্তু ছোট বাচ্চা বলে পানির হিসাবটা ঠিকমতো রাখা সম্ভব হয়না সেক্ষেত্রে বাচ্চার প্র¯্রাব দেখি আমরা ২৪ ঘন্টায় যদি ৬ বারের বেশি প্র¯্রাব করে তাহলে তার ডিহাইড্রেশন হয়নি। শিশুদের শরীরের বেশির ভাগই পানি বড়দের শতকরা ৬০ ভাগ আর শিশুদের ৭০ বা ৭৫ ভাগ যা বেশিরভাগই কোষের বাইরে থাকে। বাচ্চা ডেঙ্গু ছাড়াও ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হলেও তার বাইরের এই পানি ভেতরে চলে যায় অর্থাৎ কোষের ভেতরে চলে যায় এবং তা বাইরে বেড়িয়ে আসে ফলে বাচ্চা ডিহাইড্রেশনে ভুগে। এমন পরিস্থিতি হলে দ্রæত বাচ্চাকে নিকটস্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। স্যালাইন খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও সাবধান থাকতে হবে বেশি ঘন স্যালাইন খাওয়ালে বাচ্চার সোডিয়াম বেড়ে যাবে, সোডিয়ামের ঘনত্ব বেড়ে গেলে বাচ্চা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, খিঁচুনি হতে পারে, বাচ্চা মারাও যেতে পারে কারণ এই সোডিয়াম ব্রেনে চলে যায় বাচ্চা মারা না গেলেও ব্রেনে একটি পার্মানেন্ট ডেমেইজ হয়ে যেতে পারে।