কমিটি গঠনে আইন অনেকটাই উপেক্ষিত
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
২০০১ খ্রিস্টাব্দ পরবর্তী কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে ইচ্ছুক হলে দলটিকে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত হতে হবে। এক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দলকে বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরবর্তী তার নিজস্ব প্রতীকে যেকোনো সংসদ নির্বাচনে ন্যূনপক্ষে একটি আসনে বিজয়ী হতে হবে অথবা উপরোক্ত সংসদ নির্বাচনের যেকোনোটিতে রাজনৈতিক দলটির প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বী আসনসমূহে প্রদত্ত ভোটের ন্যূনতম ৫ ভাগ ভোট প্রাপ্ত হতে হবে অথবা যে নামেই ডাকা হোক না কেন দলটির একটি কেন্দ্রীয় কমিটি বিশিষ্ট কার্যকরি কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং ন্যূনপক্ষে ১০টি প্রশাসনিক জেলায় জেলা কার্যালয় এবং ন্যূনপক্ষে ৫০টি উপজেলা অথবা মেট্রোপলিটন থানায় কার্যালয় থাকতে হবে। তাছাড়া দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং সকল পর্যায়ের কমিটির সদস্যগণ নির্বাচিত হতে হবে মর্মে গঠনতন্ত্রে সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে।
দেশে বর্তমানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দুটি দলকে বোঝায়। নব্বই পরবর্তী এ দুটি দল পর্যায়ক্রমিকভাবে সরকার পরিচালনা করে আসছে। এ দুটি দল ছাড়া অপর যে দুটি দলের জনভিত্তি রয়েছে সে দল দুটি হলোÑ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী; তবে বিভিন্ন বিতর্কিত ভূমিকার কারণে বর্তমানে জাতীয় পার্টির জনসমর্থন এতই ক্রমহ্রাসমান যে আগামী যেকোনো অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে এ দলটির যেকোনো প্রার্থীর বাংলাদেশের যেকোনো নির্বাচনি এলাকা হতে নির্বাচিত হওয়া অত্যন্ত দূরূহ। উপরোক্ত চারটি দল ছাড়াও আরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দল রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত কিন্তু বর্তমানে জনমতের অবস্থান বিবেচনায় এ সকল দলের কোনোটিরই শীর্ষ নেতৃত্বের কারও পক্ষে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে বিজয়ী হওয়া দূরের কথা জামানত রক্ষা করাই দায়।
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত প্রতিটি দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ অপরাপর সকল পর্যায়ের কমিটির সদস্যদের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য দলীয় কাউন্সিলরদের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় উপরোক্ত চারটি দলকে দেখা গেছে, কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ আগেকার সকল পর্যায়ের কমিটিসমূহ বাতিল করত নতুন কমিটি গঠনের প্রয়াস নিয়েছে। আমাদের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া যথাক্রমে দীর্ঘ ৩৫ ও ৩২ বছর যাবৎ আসীন রয়েছেন। দলের মধ্যে তাদের উভয়ের এমন অবস্থান যে, তারা আন্তরিকভাবে সভাপতির পদ ত্যাগ করতে চাইলেও দলীয় নেতা-কর্মীদের আকাক্সক্ষার বাইরে তাদের জন্য পদ ত্যাগ করে দলে সক্রিয় থাকা বাস্তবতার নিরিখে অনেকটাই অসম্ভব। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তাদের ন্যায় অনুরূপ নেতার আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করা গেছে কিন্তু এদের অনেককে দেখা গেছে, দলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবং উপযুক্ত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ সৃষ্টির প্রয়াসে নেতৃত্ব ত্যাগে নেতা-কর্মীদের সম্মত করাতে সমর্থ হয়েছেন। জাতীয় পার্টির সৃষ্টিলগ্ন হতেই হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দলটির শীর্ষ পদে আসীন রয়েছেন এবং তার জীবদ্দশায় অপর কারও এ পদে আসীন হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হবে এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলসহ বিগত কাউন্সিলগুলোতে দেখা গেছে, দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে যাদেরই স্থান হয়েছে তা যতটুকু না কাউন্সিলরদের সমর্থনে তার চেয়ে অধিক শীর্ষ নেতৃত্বের আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে। গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহের নির্বাচনের বিষয়টি কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ পর্বে কাউন্সিলরদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে প্রস্তাব ও সমর্থনের মাধ্যমে সমাধা করা হয় বিধায় শীর্ষ নেতৃত্বের আকাক্সক্ষার বাইরে একই পদে দুটি নামের প্রস্তাব সাধারণত প্রত্যক্ষ করা যায় না। অবশিষ্ট পদের বিষয়ে পরবর্তীতে ঘোষণা দেওয়া হয় বিধায় তা সাধারণত শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়। এখানেও দেখা যায় কাউন্সিলরদের ভোটের ভূমিকা গৌণ। এমনও দেখা গেছে, শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ হতে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা অসন্তোষের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কায় বিচ্ছন্নভাবে দু’একটি ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।
গণতন্ত্রের শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন। যেকোনো রাজনৈতিক দলে প্রতিটি পর্যায়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কমিটি গঠন করা হলে তাতে দলের নেতৃত্বে উপযুক্ত ও যোগ্য লোকের আবির্ভাব ঘটবে। দেশে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের শীর্ষ নেতৃত্বে একদিকে যেমন একই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে আসীন অপরদিকে তাদের বিদায়ে তাদের স্থলে নিজ পরিবারের অপর কারও যে আগমন ঘটবে এটা অনেকটা নিশ্চিত। আর তাই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দলে শীর্ষ নেতৃত্বের বাইরে যত যোগ্য ব্যক্তিরই আগমন ঘটুক না কেন তার পক্ষে যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়ে শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হওয়া সম্ভাবনার বিপরীত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এরূপ দল কখনো দীর্ঘ মেয়াদে দলের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এ রাজনৈতিক দলের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধনের বিধান এবং কাউন্সিলরদের ভোটে দলের সকল পর্যায়ের কমিটিতে নির্বাচিত হওয়ার বিধান সংযোজন পরবর্তী যেভাবে নির্ধারিত মেয়াদান্তে আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলসমূহ কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি নির্বাচন সম্পন্ন করছে তা নেহাতই আইনি বাধ্যবাধকতার অনুসরণ বৈ অধিকাংশ পদের ক্ষেত্রে কাউন্সিলরদের সমর্থনের প্রকৃত প্রতিফলনের বাস্তবরূপ নয়।
সম্পাদনা: আশিক রহমান