সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে আইএমএফ’র তিন পরামর্শ
সোহেল রহমান : [১] স্বল্প মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারকে নিকটস্থ সামনের মেয়াদে তিনটি পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এগুলো হচ্ছেÑ মুদ্রানীতির রাশ টেনে ধরা অর্থাৎ আরও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ণ; নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি গ্রহণ ও মুদ্রার বিনিময় মুদ্রা বিনিময় হার সম্প্রসারণমূলক বা নমনীয় করা। বাইরের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে এসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে, সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের ওপর যেন তার প্রভাব না পড়ে। শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার গুরুত্ব তুলে ধরেছে আইএমএফ।
[২] মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় বাংলাদেশের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের প্রস্তাব অনুমোদনকালে এসব পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য অনুমোদিত ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের আওতায় দ্বিতীয় কিস্তি হিসেবে ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের ছাড়ের অনুমোদন দেয়া হয়। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
[৩] এদিকে মঙ্গলবার রাতেই গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের প্রস্তাব অনুমোদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
[৪] বৈঠক শেষে এক সংবাদ বিঞ্জপ্তিতে মুদ্রানীতির কাঠামো আরও আধুনিকায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের প্রশংসা করেছে আইএমএফ। মুদ্রানীতি আধুনিক হলে এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির প্রভাব জোরদার হবে। মুদ্রার একক বিনিময় হার গ্রহণের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে আইএমএফ এ ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে আরও নমনীয় হওয়ার ওপর জোর দিয়েছে। তারা মনে করে, অর্থনীতির বহিস্থঃ ধাক্কা মোকাবিলায় এটি জরুরি।
[৫] আইএমএফ-এর মতে, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সংস্থাটির শর্ত পরিপালনে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে পথচ্যুত হয়নি। এ ছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ যেসব সংশোধনমূলক ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে ও জরুরি সংস্কার বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছে, তাকে স্বাগত জানিয়েছে বহুপক্ষীয় এ সংস্থাটি।
[৬] আইএমএফ-এর মতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৬ শতাংশ প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমতির দিকে থাকলেও রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। কঠোর মুদ্রানীতি ও নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতির কল্যাণে মূল্যস্ফীতির হার আগামী অর্থবছরের শেষ নাগাদ ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে থাকবে।
[৭] আইএমএফ-এর মতে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক বিনিয়োগ জরুরি। করনীতি সংশোধন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কর-রাজস্ব বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে সংস্থাটি। ভর্তুকির যৌক্তিকীকরণ, ব্যয় করার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আরও দক্ষতার সঙ্গে আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্ব দিয়েছে তারা।
[৭] আইএমএফ-এর মতে, উন্নয়নের জন্য দেশে অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এ বাস্তবতায় আর্থিক খাতের সংস্কার জরুরি। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি পুঁজি পুনরুদ্ধারে বিশেষ কৌশল প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। পরিচালকেরা এ বিষয়ে একমত যে ব্যাংক খাতের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার করা, শাসনব্যবস্থার উন্নতি ও দেশীয় পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করা গেলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
[৮] জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা প্রয়োজন; সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার তাগিদ দিয়েছে তারা। সংস্থাটি মনে করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা ব্যবস্থা উন্নত হলে, তা আর্থিক খাতের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের তহবিলও পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক দিন ধরেই নানাবিধ সংস্কার প্রয়োজনÑউচ্চমধ্যম আয়ের কাতারে পৌঁছাতে গেলে এসব জরুরি বলে মনে করে আইএমএফ। সেই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধি, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে শ্রমশক্তিতে বাণিজ্য উদারীকরণ, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন, শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন ও নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা জরুরি।