দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলে সংকটের সমাধান হবে কি?
ড. মাহফুজ কবীর
৮-১০টি ব্যাংকের একীভূতকরণের কথা বলা হয়েছে, সেটা বাড়তে পারে। এমনকি কমতেও পারে। সময় নিয়েই কাজ করা হবে। ব্যাংকের পরিস্থিতি বুঝে একীভূতকরণ করা হবে। চার ক্যাটাগরিতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ সব থেকে বেশি বা ১৪ শতাংশের বেশি। একইসঙ্গে তাদের সিআরআর কমÑ এমন দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ২৪ মাস পর্যবেক্ষণ করে দেখবেন উন্নতি হয় কিনা, তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই কথা বলছিলাম। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করা হোক। ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশনের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বাংলাদেশ ব্যাংক সে কাজগুলো করছিলো কিন্তু দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সঠিকভাবে আর পরিচালনা করা যাচ্ছিলো না। বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে এবং দিন দিন ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা প্রকট হচ্ছে। কেবলমাত্র বেসরকরি ব্যাংক দুর্বল তা নয়, সরকারি ব্যাংকেও দুর্বলতা আছে। আমার মনে বড় প্রশ্ন আছে দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে সরকারি ব্যাংকেও আছে কিনা? সোনালি, রূপালি, জনতা, অগ্রণী ব্যাংকের কথা তো আমরা জানি। এছাড়াও কমার্শিয়াল ব্যাংক নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে জনগণের করের অর্থেই সেটা চলে। খুব দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করার যথেষ্ট যুক্তি ছিলো বিধায় করা হয়েছে।
নতুন ব্যাংকগুলো যে খুব ভালো করছে তা কিন্তু না এছাড়াও বেশকিছু ব্যাংকে রাজনৈতিক অরাজকতা চলছিলো। অনেক সময় দেখা গেছে একজন পরিচালনা পর্ষদ ভালো ব্যাংককে খারাপ ব্যাংকে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন। সুতরাং এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। কারণ ব্যাংকিং খাত ব্যবসা নয়Ñ এটা হলো পুরো আর্থিক খাতের চালিকা শক্তি। একটা ব্যাংক যদি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়, তবে পুরো ব্যাংক ব্যবস্থাপনাই চাপের মুখে পরে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ৩৮টি ব্যাংক যদি দুর্বল হয়, তাহলে আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। এটাকে ব্যবসা বা বিনিয়োগ হিসেবে দেখলে চলবে না এবং আমাদের শেয়ার মার্কেটেও আছে, তাই দায়িত্বটা আরো অনেক বেশি। এ মুহূর্তে আমরা যে ঋণ নিচ্ছি, সেটার জন্য আমাদের একটা টার্গেট আছে। যেমন ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ ও সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশ খেলাপি ঋণ থাকতে হবে। এমনকি দীর্ঘদিনের ব্যাংক খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে পরিকল্পনা আছে এই সুযোগে আমরা ব্যাংক খাতকে মানসম্মত করতে পারবো এবং আর্থিক খাতের জন্য মাইলফলক দৃষ্টান্তমূলক হবে।
দুর্বল ব্যাংক ও সবল ব্যাংকের তালিকা গোপন থাকা ভালো তা না হলে বিনিয়োগকারী, সাধারণ আমানতকারী ও ব্যবসায়ী যারা ঋণ নিচ্ছে তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। তবে পুরোপুরি গোপন না করে ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে সামান্য কিছু তথ্য আদান-প্রদান করা হয় সেক্ষেত্রে প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হয়। এতে করে আমাদের মাঝে গুজব ও বিভ্রান্তি তৈরি না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। আরেকটা কথা জানিয়ে রাকতে চাই ব্যাংকের ঋণ নিয়ে কোনো গুজবে যেন জনগণ কান না দেয়। সর্তকতা বজায় রাখার জন্যই তালিকা গোপন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক একা কাজ করছে না এখানে আইএমএফ সরাসরি যুক্ত না থেকে সহযোগিতা করছে যেন আর্থিক খাতটি স্মার্ট সিস্টেমে চলতে পারে এমন সরকারি কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায়। ২০১০ সালের পর আমরা নতুন ব্যাংকের পক্ষে ছিলাম। ভেবেছিলাম প্রতিযোগিতা বাড়বে, সেবার মানও বাড়বে। কিন্তু তার উল্টোটা হয়েছে। বরং ব্যাংকগুলোকে আরো দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানে আমরা ব্যাংকিং খাতের প্রতিযোগিতার মান ও সেবার মান বাড়াতে চাচ্ছি এবং ২০২৬ সালের মধ্যে আমরা যে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করতে যাচ্ছি তার জন্য আর্থিক প্রস্তুতি দরকার। একইসঙ্গে আমাদের আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতকে সংকট থেকে ফিরিয়ে আনা।
বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেবেÑ এটা তারা গ্যারান্টি দিয়েছেন, তাই জনগণের আস্থা থাকা দরকার। ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের সমস্যা বেশ সময় নিয়ে ও বুদ্ধিমত্তার সাথেই বাংলাদেশ ব্যাংক তা মোকাবেলা করেছে। তবে দুটো ক্যাটাগরি মেনে চলা ভালো ক্যাটাগরি ৩, ব্যাংক নতুন ঋণ দিতে পারবে না বা নতুন ব্যবসায় জড়াতে পারবে না এবং ক্যাটাগরি ৪, যে কোনো সময় ব্যাংক বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং যে ব্যাংকগুলোয় ঝুঁকি বেশি আমি মনে করি তাদের ক্ষেত্রে একীভূতকরণ হতে পারে। আসলে তারা জানে তাদের ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি। বাংলাদেশ ব্যাংক আশ্বস্থ করেছে সেক্ষেত্রে জনগণের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।
যে ব্যাংকগুলোকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফল। তারা কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের যথেষ্ট সময় দেওয়ার পরেও। সবল ব্যাংকের সাথে দুর্বল ব্যাংককে একত্রিত করি তাহলে তাদের মাঝেও এ সমস্যা তৈরি হতে পারে তাদের দৈনিক কাজেও বাঁধা-বিপত্তি আসতে পারে। এছাড়াও আরো কিছু বিষয় আছে তা হলো, ১৫ বছর আগের সবল ব্যাংক সেখানকার পরিচালনা পর্ষদের জন্যেই দুর্বল হয়েছে। একীভূতকরণের পর দুর্বল পরিচালনা পর্ষদকে নাও রাখতে পারে। দায়-ভার ও খেলাপির জবাবদিহিতা নিতে হবে। পরিচালনা পর্ষদের মাঝে নীতি ও নৈতিকা থাকা বাঞ্চনীয় তা না হলে র্দুবলতা দূর করে অর্থনৈতিক খাতকে রক্ষা করা যাবে না। এমনকি দুর্বল-সবল ব্যাংকের একীভূতকরণ বৃথা যাবে।
দুর্বল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে ভেঙে কর্মীদের সবল ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে যার যার পদ নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না। সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের ঋণ শোধ করার যে বোঝা ঘাড়ে নিয়েছে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু সুবিধা সবল ব্যাংককে দেওয়া উচিত এ প্রক্রিয়ায় কাজ করলে সফল হবার সম্ভাবনা আছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত দুর্বল ব্যাংককে সবল হবার যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে এর মাঝেই স্বেচ্ছায় একীভূতকরণ করা উচিত তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই তা সামাল দিতে পারবে না। কারণ কে কোন ব্যাংককে নিতে চাইবে, এটা নিয়েও ঝামেলা হতে পারে।
সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা বেশ খারাপ। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়, একীভূতকরণের দিক থেকে বলা যায়, অনেক সরকারি ব্যাংক রয়েছে যারা ব্যবসার মতো করেই ঋণ দিয়ে তাদের সঙ্গে একীভূত হয়ে কাজ করার বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। এতে করে সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংক একীভূত হতে পারে। আইএমএফের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ব্যাংক একত্রিত হয়ে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের ঘাটতি পর্যবেক্ষণ করবে, এতে অবশ্যই ইন্টারন্যাশনালি মানসম্পন্ন হওয়াটা খুবই ভালো। যদি কোনো ঘাটতি থাকে তাহলে আর্থিক লেনদেনের জন্য তা ভালো হবে না সেক্ষেত্রে মনিটরিং, রেগুলেশনের প্র্যাক্টিসের সার্পোট দেওয়ার জন্য যদি সরাসরি আইনের নজরদারি থাকে এবং বিশ্বব্যাংক, এডিবি আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমাদের পদক্ষেপ ও উদ্যোগ সফল হবে এবং মান সম্পন্ন ব্যাংকিং খাত তৈরি হবে।
পরিচিতি: ড. মাহফুজ কবীর, অর্থনীতিবীদ। এটিএন নিউজের ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিও কনন্টেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন রুদ্রাক্ষী আকরাম