মধ্যবিত্তের সংবাদপত্র পাঠ
মোজাফফর হোসেন
ধর্ষণের খবর। রোজ আসে। আমার স্ত্রী পাতাটা টেনে নিয়ে ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে দেখে নেয়। আক্রান্ত নারীর ছবি দেওয়া হয়নি। অন্যান্য পরিচয় দেওয়া আছে। চাঁদপুরে আমাদের কেউ নেই, না? স্ত্রী জানতে চায়। না। আমি ছোট করে উত্তর দিই। আমার স্ত্রী মুখটা হাসি হাসি করে খবরের কাগজটা রাখে। বলে, মেয়েটা ক্লাস থেকে ফিরেছে। ভার্সিটির বাসটা বাসার গেইটে নামিয়ে দিয়ে যায়। আর আমার তো বয়স হয়েছে, বাইরেও তেমন যাই না। ওকে অনেক নিশ্চিন্ত মনে হয়। একটা খুন হয়েছে, শেরপুরে। ছেলে বাবাকে হত্যা করেছে। সম্পত্তির জন্য। ওকে বলি। আমি তো খুব চেয়েছিলাম। তুমিই সায় দিলে না। একটা মেয়ের পর একটা ছেলে কে না চায়। এখন মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে। আমার স্ত্রী বলে। আমাদের ওতো সম্পত্তিই- বা কোথায়। ওকে বলি। প্রভাবশালী নেতা একটা পরিবারের শেষ জমিটুকু দখল করে নিয়েছে। খুনের সংবাদের নিচেই খবরটা আছে। দেখেই মনে হলো, গ্রামে যা ছিল তাও বিক্রি করে দিয়েছি।
পোস্টঅফিসে সঞ্চয়পত্র কিনে ভালো করেছ। আমার স্ত্রী বলে। আমাদের ব্যাংক ব্যালেন্স শূন্য। শেয়ার বাজারেও লগ্নি করতে পারিনি। রিজার্ভ চুরি, ঋণখেলাপি, শেয়ারবাজারের ধস এই খবরগুলো দেখে আমরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে অন্য খবরে যাই। পেইজ উল্টাতেই চোখে পড়ে, সংখ্যালঘু একটি পরিবারকে ভিটে থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই খরবটাও নতুন না। পড়তে পড়তে আমি বলি, চলো এবার ঈদে ছাগল না দিয়ে গরু দিই। স্ত্রী চুপ করে থাকে। একটা সংবাদ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, দেখো, পেনশনের টাকায় হজ করতে চেয়েছিল, জালিয়াতির খপ্পরে সর্বস্বান্ত হয়েছে। আমাদের এলাকার ঘটনা। খবরে ভিকটিমের ছবি দেওয়া আছে। আমি ভালো করে দেখি। বড়ভাই পেনশনের টাকা দিয়ে এবার হজে যাচ্ছেন। ছবির লোকটির সঙ্গে তার চেহারা মেলে না।
এরপর পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে শব্দ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকি দুজনে। মায়ের গয়না চুরি করে ঘুষ দিয়েছে, তবু চাকরিটা পেলো না। টেন্ডারবাজিতে প্রাণ গেলো দুই তরুণের। চার বছরের শিশুকে খুন করেছে বাবা ও ভাই। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো বর ও কনেসহ দশজনের। ধর্ষণের বিচার না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ। সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক পরিবারের তিনজনের মৃত্যু। ক্রসফায়ার। ভুল চিকিৎসায় প্রাণ গেলো কিশোরের। খবরগুলো চোখ বুলিয়ে যাই। কোনো খবরের সঙ্গে ছবি থাকলে আমার স্ত্রী দেখে। মাঝে মধ্যে আমাকেও দেখায়। প্রতিদিন আমরা এই খবরগুলো কিনি। পেপার না কিনলে কটা টাকা বাঁচে। কিন্তু এত অল্প টাকায় যেখানে নিজেদের নিরাপত্তার খবরগুলো কিনতে পাওয়া যায় সেখানে না কেনার প্রশ্নটি আমাদের মধ্যে কেউ কখনো তোলে না।
প্রতিদিন খবর পড়তে পড়তে আমরা বিশ্বাস করি, যাদের নাম পত্রিকায় আসে, যাদের ছবি ছাপা হয়, তারা অন্য কেউ। আমাদের বাস্তবজীবনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সিনেমা দেখার মতো খবরগুলো পড়তে পড়তে চা হাতে আমরা আমাদের গল্পগুলো করি। রোজকার মতো আজও পেপার আসে। অন্যদের খবর পড়তে পড়তে নিজেদের গল্পগুলো মনে করার চেষ্টা করি। আমার স্ত্রী ছবিগুলো দেখে। একটা ছবিতে সে থামে। ধরে থাকে। মেয়েটার ক্ষতবিক্ষত মুখটা অস্পষ্ট করে দেওয়া। পোশাকটা দেখে চেনার চেষ্টা করে। আমাকে দেখায়। লিখেছে অজ্ঞাত। বিবরণ পড়ে সন্দেহ দানা বাঁধে। কালকের কাগজের জন্য অপেক্ষা করতে হবে?
আমি বোকার মতো বলি। মোবাইল করলেই তো জানা যায়। বলে স্ত্রী উঠে দাঁড়ায়। ফোনটা নিতে ঘরের ভেতরে যায়। ও কাঁপছে বুঝতে পারি। টলছে। আমি নিরুদ্বেগে বসে থাকি। আমরা কখনো কোনো খবরের শিরোনাম হইনি। যাদের খবর আমরা রোজ পড়ি, খবরের কাগজে যাদের ছবি আমরা বছরের পর বছর দেখে আসছি, তারা অন্য কেউ। মনে হয় সিনেমা-নাটকে দেখা মানুষগুলোর মতো বানানো চরিত্র। এটা ভেবে আরো নিশ্চিন্ত হতে পারি। লেখক : কথাসাহিত্যিক