সিগারেট ছাড়ার সুখ!
সিগারেট ছেড়ে দিলে মাসে ছয় হাজার টাকা বাঁচবে, সিগারেট ছাড়ার মূল কারণ আসলে এটি নয়। অর্থপ্রীতি আমার কোনোকালেই ছিল না, এখনও নেই, ভবিষ্যতে থাকার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। মূল কারণ আসলে অন্য। গত প্রায় চার বছর ধরে আমি আসলে একধরনের ডিপ্রেশনে ভুগছি। সবকিছুই আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। মুহূর্তে মুহূর্তে মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। মনে হয়, এই বুঝি আমি স্ট্রোক করলাম! এই সমস্যাটা প্রথম দেখা দেয় ‘রাজনটী’ লেখার সময়। খুব রাত জাগতাম তখন। হঠাৎ একরাতে বুকের ডান দিকে প্রচ- ব্যথা টের পাই। প্রচ- একটা চাপ। ভাবলাম, হার্ট অ্যাটাক বুঝি! সারারাত নির্ঘুম কেটে গেল। সকালে ডাক্তারের কাছে গিয়ে আমার হার্ট অ্যাটাকের কথা জানালাম। ডাক্তার কী কী সব টেস্ট করে বললেন, আপনার হার্ট তো একদম সুস্থ, অ্যাটাকটা হলো কোথায়? আমি তখন বুকের ডান দিকটা দেখিয়ে বললাম, এই যে এখানে হয়েছে। ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, হার্ট ওখানে থাকে না, ওখানে থাকে ফুসফুস। আপনার কিচ্ছু হয়নি। সিগারেটটা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখুন, আর রাত জাগা ছাড়েন, সব ঠিক হয়ে যাবে। এটা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা।
সিগারেট বন্ধ রাখতে পারিনি, রাত জাগাও ছাড়তে পারিনি। একদিন স্মরণ নিলাম কথাসাহিত্যিক ও মনোচিকিৎসক ড. মোহিত কামালের। তিনি ওষুধ খেতে দিলেন। কিন্তু ওষুধগুলো খেলে শুধু ঘুম পায়। তাতে আমার পড়ালেখার ক্ষতি হয়। তাই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলাম। বছরখানেক পর একটি বিশেষ কারণে স্ট্রোক ও মৃত্যুচিন্তা বিষয়ক এই উৎপাত থেকে রেহাই পেলাম। কারণটা উহ্য থাক। কিন্তু গত দেড় বছরে চাঞ্চল্যকর দুটি হত্যাকা-ে আবার প্রবলভাবে তা মনে চাগা দিয়ে উঠল। সিগারেট ধরানো মাত্রই স্ট্রোকের কথা মনে পড়ে যায়। রোজ সকালে নাস্তা করে যখন সিগারেট ধরাই একধরনের অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। মনে হয়, আমার দিনটাই শুরু হলো অপরাধের মধ্য দিয়ে। রাতে যখন রুমের দরজা বন্ধ করে লিখতে বসি, লেখার সময় যখন সিগারেট ধরাই, আমার মনোযোগ তখন লেখা থেকে ডাইভার্ট হয়ে স্ট্রোকের দিকে ধাবিত হয়। গতকাল রাতেও এ সমস্যাটা হচ্ছিল খুব। আমি বারবারই লেখার দিকে মনযোগী হতে চাচ্ছি, অথচ আমার মনযোগ চলে যাচ্ছে কিনা মৃত্যুচিন্তার দিকে! ঠিক তখনই আমি সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবি।
আমি একটি উপন্যাস লিখতে চাই। সেটি লেখার জন্যই মূলত বেঁচে থাকা। ওটা লিখে মরে গেলেও নো প্রোবলেম। সমস্ত মনযোগ এখন ওদিকে ধাবিত করতে চাই।
আজ সারাদিন একটা সিগারেটও খাইনি। দুপুরে খুব অস্থির লেগেছিল। মনকে তখন এই প্রশ্ন করেছিÑ কোনটি? লেখা না সিগারেট? লেখার পাল্লাই ভারি হলো। বিকেলে মোহিত ভাই ফোন করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপস দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি এখনও জয়ী, নাকি পরাজিত।’ বললাম, ‘জয়ী’। মোহিত ভাই বললেন, ‘বাহ! তুমি পারবে।’ আমি জিজ্ঞেস করালাম, ‘সিগারেট ছেড়ে দিলে আমার লেখালেখির কোনো ক্ষতি হবে না তো?’ মোহিত ভাই বললেন, ‘তুমি কি তোমার লেখার কাছে দায়বদ্ধ, নাকি সিগারেটের কাছে?’ আমি আর কথা বাড়ালাম না। তিনি যথার্থ বলেছেন বটে।
গোটা চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেল আমি সিগারেট খাইনি। কী আশ্চর্য! সিগারেট ছাড়া লিখতে পারি কিনা, স্ট্যাটাসটি লিখে তার ট্রায়াল দিলাম। লিখতে পারছি তো। কোনো অসুবিধা তো হচ্ছে না। প্রায় তেইশ বছর ধরে তামাকের যে শলাকা আমার সঙ্গী, আজ তারা আমার সঙ্গে নেই। ‘ব্যানসন ব্লু গোল্ড’ লেখাটা হারানো প্রেমিকার মুখের মতো চোখের সামনে ভাসছে। মাথাটা এখন প্রচ- ঝিঝি করছে। আমি কি পারব সিগারেট ছাড়তে? আমি কি সফল হব? প্রকৃতি কি আমার সহায় হবে?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন