বিভাজিত জাতি, বিপন্ন গণতন্ত্র
ইকতেদার আহমেদ
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের এক বিরাট অংশ ইংরেজি ভাষাভাষী শেতাঙ্গ হলেও মূলত এটি একটি বহুজাতি ভিত্তিক অভিবাসীদের দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের আদি অধিবাসীদের বলা হয় রেড ইন্ডিয়ান। রেড ইন্ডিয়ানরা এশিয়ান বংশোদ্ভুত। ইউরোপিয়দের যুক্তরাষ্ট্রে পদার্পণ ঘটলে রেড ইন্ডিয়ানদের উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের দ্বারা অত্যন্ত নির্মম ও পৈশাচিকভাবে হত্যার শিকার হন। যুক্তরাষ্ট্র নাগরিকত্ব বিষয়ে জন্ম ও অভিবাসী এ দুটি সূত্র অনুসরণ করলেও সেখানে বসবাসরত জন্মসূত্রে নাগরিকরা তিনটি ধারায় বিভাজিত। এর একটি ধারা হলো, যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপ হতে আগত শেতাঙ্গ আমেরিকান এবং অপর দুটির একটি আফ্রিকা হতে আগত আফ্রিকান-আমেরিকান ও অপরটি ইউরোপ হতে আগত স্প্যানিশ ও ল্যাটিন ভাষাভাষী হিস্পানিক ও ল্যাটিনো আমেরিকান। এর বাইরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ হতে সে দেশে অভিবাসী হিসেবে আগত নাগরিকরা স্বদেশি আমেরিকান হিসেবে অভিহিত, যেমনÑ চীন হতে আগত অভিবাসী আমেরিকানদের বলা হয় চাইনিজ আমেরিকান, অনুরূপ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি হতে আগত অভিবাসীদের বলা হয় বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, জাপানি ও কোরিয়ান আমেরিকান।
বাংলাদেশ একটি সমজাতিভিত্তিক দেশ হলেও পাকিস্তান ও ভারত অনুরূপ নয়। পাকিস্তান ৪টি প্রধান ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষুদ্র জাতি সমন্বয়ে গঠিত একটি দেশ। পাকিস্তানের ন্যায় ভারতও ১৮টি প্রধান ও শতাধিক ক্ষুদ্র জাতি সমন্বয়ে গঠিত একটি দেশ। জাতি, ধর্ম নির্বিভেদে পাকিস্তান ও ভারতের সকল নাগরিকরা যেমন পাকিস্তানি ও ভারতীয় নামে অভিহিত অনুরূপ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিভেদে আমেরিকায় বসবাসরত সকল নাগরিকরা বৃহদার্থে আমেরিকান নামে অভিহিত।
যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে একটি মানবতাবাদী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করলেও সেদেশে চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাভাষী শেতাঙ্গ আমেরিকানরা যত না সুবিধাভোগী, অপর কোনো দেশের জন্ম বা অভিবাসী সূত্রের আমেরিকানরা সে অনুযায়ী সুবিধাভোগী নয়। এটি আইনের দৃষ্টিতে সমতাবিষয়ক মানব ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হলেও ইংরেজি ভাষাভাষী শেতাঙ্গ আমেরিকানরা সেটি মানতে নারাজ।
যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রটির আয়তন ও সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অপ্রতুল। সেখানকার চাষযোগ্য জমির একটি অংশ লোকবল ও চাহিদার অভাবে পতিত অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া দেশটিতে শ্রম সংশ্লিষ্ট পেশায় প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দেশটির কঠোর অভিবাসী নীতির কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিশেষত এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য পৃথিবীর যেকোনো দেশে প্রবেশের দ্বার অবারিত। সে দৃষ্টিকোণ হতে যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতই মানবতাবাদী রাষ্ট্র হয়ে থাকলে সে দেশটিতেও পৃথিবীর অপরাপর দেশ বিশেষত এশিয়ান, আফ্রিকান ও ল্যাটিন আমেরিকানদের প্রবেশাধিকার অবারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার রয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুসৃত নির্বাচনের মাধ্যমে সে দেশের জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে থাকেন; তবে সে দেশের নির্বাচন পদ্ধতির সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন পদ্ধতির পার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি আসনে সর্বাধিক সংখ্যক ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিজয়ী হিসেবে পরিগণিত হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনপ্রাপ্ত দল সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। ইউরোপের অপরাপর অধিকাংশ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সে সকল দেশে আনুপাতিক ভোটপ্রাপ্তির ভিত্তিতে দলসমূহের মধ্যে আসন বন্টন হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনপ্রাপ্ত দল সরকার পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজ্যের জন্য নির্ধারিত সংখ্যক ইলেকট্রোরাল ভোট রয়েছে এবং একটি রাজ্যে যে দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ভোটপ্রাপ্ত হবে, সে রাজ্যের সকল ইলেকট্রোরাল ভোট সে প্রার্থীর অনুকূলে যাবে। ইতোপূর্বে একাধিকবার দেখা গেছে, সাধারণ ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও ইলেকট্রোরাল ভোটে বিজয়ী না হওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বিজয়ী হতে ব্যর্থ হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সংসদকে বলা হয় কংগ্রেস। কংগ্রেস হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সিনেট সমন্বয়ে গঠিত। কংগ্রেসে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এর সদস্য সংখ্যা ৪৩৫, অপরদিকে সিনেটের সদস্য সংখ্যা ১০০। এর অতিরিক্ত ওয়াশিংটন ডিসি হতে ৩ জন সদস্য নির্বাচিত হন। ওয়াশিংটন ডিসির এ ৩টি ইলেকট্রোরাল ভোটসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সর্বমোট ইলেকট্রোরাল ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বিজয়ী হতে হলে তার জন্য ন্যূনতম ২৭০টি ইলেকট্রোরাল ভোট পাওয়া আবশ্যক।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বরাবরই ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান এ দুটি দলের একক প্রাধান্য রয়েছে। এ যাবৎকাল পর্যন্ত এ দুটি দল বহির্ভূত অপর কোনো দলের প্রার্থী বিজয়ী হওয়া দূরের কথা, প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই আসতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে দীর্ঘদিন যাবৎ অনুসৃত নীতি অনুযায়ী ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান দলের প্রার্থীদ্বয় সমগ্র দেশ তথা বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারিত তিনটি টেলিভিশন বিতর্কে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এ টেলিভিশন বিতর্কে উভয় প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনুসৃত নীতি কি হবে সে বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরেন। এ বিতর্কের ফলাফল একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ভোটের ফলাফলের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ইতোপূর্বেকার অনুষ্ঠিত টেলিভিশন বিতর্কের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এক প্রার্থী অপর প্রার্থীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ পরিহার করে চলতেন এবং বিতর্কের প্রারম্ভে ও শেষে হাসিমুখে একে অপরের সঙ্গে করমর্দন করতেন। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে টেলিভিশন বিতর্কের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অতীতের শালীনতা ও মার্জিতভাবের ব্যত্যয়ে উভয় প্রার্থী কদর্যভাবে একে অপরকে আক্রমণ করা ছাড়াও ন্যূনতম সৌজন্যবোধের পরিচয়ে করমর্দন পর্যন্ত এড়িয়ে চলেছেন। টেলিভিশন বিতর্কের বাইরে নিজ নিজ দলকর্তৃক বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আয়োজিত সভায় রিপাবলিকান প্রার্থীকে দেখা গেছে ডেমোক্রেট প্রার্থীকে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে তাকে ভোট দিলে যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক শাসতান্ত্রিক সঙ্কটে পড়বে এমন অনুযোগ করে চলছেন। রিপাবলিকান প্রার্থী এমনও বলছেন, ডেমোক্রেট প্রার্থীকে ভোট দেওয়া অর্থ অভিসংশনের সমর্থনে ভোট প্রদান। রিপাবলিকান প্রার্থী ডেমোক্রেট প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদেশে সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং বিদেশি রাষ্ট্রসমূহ হতে দাতব্যের নামে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহের অভিযোগও তুলেছেন। তাছাড়া ডেমোক্রেট প্রার্থীর ই-মেইল আদান-প্রদানে ব্যক্তিগত সার্ভারের ব্যবহার এবং ব্যক্তিগত সার্ভারে ব্যবহৃত ই-মেইলসমূহ মুছে ফেলাকে রিপাবলিকান প্রার্থী বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিচ্ছেন। ডেমোক্রেট প্রার্থীও রিপাবলিকান প্রার্থীর বিরুদ্ধে করফাঁকি, ব্যবসায়িক অনৈতিক সুবিধাগ্রহণ এবং মহিলাদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলেছেন আবার তাকে চোর ও প্রতারক হিসেবেও আখ্যা দিয়ে চলেছেন।
এবারই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেখা গেল, রিপাবলিকান প্রার্থী পরাজিত হলে ভোটের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন। তাছাড়া ডেমোক্রেটকর্তৃক ভোটের ফলাফলে জালিয়াতির মাধ্যমে বিজয় হাসিল করার চেষ্টা হবে বিধায় তাকে আগাম নির্বাচিত ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। রিপাবলিকান প্রার্থীর এহেন দাবি ও আচরণ কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সচেতন মানুষ যে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে গণতান্ত্রিক আচরণ ও গণতন্ত্রের ভাষা হতে বিরত, এ বিষয় দুটি আজ সে দেশের সাধারণ মানুষসহ বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্টত প্রতিভাত। উভয় দলের বিশেষত রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে যে অবস্থান তা দেশটির জাতীয় ঐক্য ও সংহতি এবং গণতন্ত্র বিষয়ে বড় ধরনের ব্যাঘাত হিসেবে দেখা দিবে। আর এ ধরনের ব্যাঘাত প্রকৃত অর্থেই বিভাজিত জাতি ও বিপন্ন গণতন্ত্রের বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান