‘সাঁওতাল করেছে ভগবান গো’
প্রদীপ মার্সেল রোজারিও
সাঁওতালদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করার ঘটনা এদেশে নতুন নয়। সাঁওতালদের রক্ষার শ্লোগান দিয়েই যুগে যুগে নানা কৌশলে তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মূলত এ উচ্ছেদ কৌশল শুরু হয় ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারাকাত- এর ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অব আনপিপলিং অব ইন্ডিজিনাস পিপল-দ্য কেইস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিয়ে এ গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৪ সালে মোট ৬৭ বছরে সাঁওতালদের ৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়েছে। আর এ উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় ১৬ ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে রক্ষার শ্লোগান দিয়েই কৌশলে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রতিবারই এ উচ্ছেদের নেতৃত্বে ছিলেন ভূমি কর্মকর্তারা। নেপথ্যে ছিলেন রাজনৈতিক নেতারা। এভাবেই গত ৬৭ বছরে সাঁওতালদের ১ লাখ ১৬ হাজার ৪০০ একর জমি হাতছাড়া হয়েছে। ড. বারাকাত তার গবেষণায় আরও দেখিয়েছেন, সাঁওতালদের ৩ ভাগের এক ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো জমি নেই।
সাঁওতাল কারা?
সাঁওতাল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নৃ-গোষ্ঠীগুলোর একটি। এরা নিজেদেরকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন রচিত মহাভারতে বর্ণিত কুরু-পান্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের প্রত্যাখ্যিত ভাবশিষ্য একলব্যের বংশধর বলে বিশ্বাস করে। সাঁওতালরা তীর চালনায় অতিশয় দক্ষ। সান্তাল, সান্তালি, হোর, হর, সাঙÍাল, সন্থাল, সান্তালি, সাতার প্রভৃতি অভিধায়ও এ নৃ-গোষ্ঠী অভিহিত হয়ে থাকে।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করে যে, আদি মানব ও মানবী পিলচু হড়ম ও পিলচু বুড়ির সাত জোড়া সন্তান থেকেই তাদের উদ্ভব। এজন্যই সাঁওতালরা সাতটি গোত্রে বিভক্ত। সাঁওতালি ভাষায় এ গোত্রগুলো ‘পারিস’ নামে অভিহিত। সাতটি গোত্র হলোÑ হাঁসদাক, সোরেন, টুডু বা হেমবরোম, কিসকু, মুরমু, মারুদি, বাস্কে। এ সাতটি গোত্র ছাড়াও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে আরও পাঁচটি গোত্রের উদ্ভব ঘটে।
সাঁওতালদের মধ্যে টোটেম বিশ্বাস প্রচলিত আছে। প্রতিটি গোত্র তাদের পূর্বপুরুষ কিংবা গাছপালা, জীবজন্তু ও পশুপাখি ইত্যাদি নামে পরিচিত। হাঁসদক গোত্রের লোকের বিশ্বাস তাদের উদ্ভব ঘটেছে হাঁস থেকে। তাই হাঁসদক গোত্রে হাঁস খাওয়া নিষিদ্ধ। সোরেন গোত্রের উদ্ভব হরিণ থেকে তাই তাদের হরিণের মাংস খাওয়া নিষেধ।
সাঁওতালরা বাংলাদেশে মূলত রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় বাস করে। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ি, চিরিরবন্দর, কাহারোল এবং রংপুর জেলার পীরগঞ্জে সাঁওতালরা অধিকহারে বাস করে। রাজশাহী, বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলায় কিছু সংখ্যক সাঁওতাল বাস করে।
ভূমি ও সাঁওতাল
ভূমি ও আত্মা সাঁওতাল জনগোষ্ঠী এক মনে করে। সাঁওতাল ছাড়াও আরও ৪৪টি নৃ-গোষ্ঠী বাংলাদেশে আছে তারাও ভূমিকে আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে। সাঁওতাল, গারো, মুন্ডা নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ ফসলের জন্য পাহাড় বা সমতোলের মাটিতে বীজ রোপন করে। এই বীজ তাদের নিকট সন্তান সমতূল্য। আর ভূমি মা। মায়ের গর্ভে ভ্রুণ যেমন, মাটির গর্ভে শস্যদানার ভূমিকাও তেমন সাঁওতালদের কাছে। মানুষ যেমন তার আত্মাকে বেচা-কেনার জিনিস ভাবে না একইভাবে সাঁওতালরা তাদের মাটি বা ভূমিকে বেচা-কেনার জিনিস ভাবে না। নথিপত্র থাকলে ভূমি আইনের বাহানা দেখিয়ে তাদের আত্মা সদৃশ ভূমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করতে পারত না। ভূমি নিয়ে উচ্চতর দর্শন, ভূমিকে ভিন্নতর দৃষ্টিকোন থেকে দেখা, ভূমিকে শরীরের অংশ মনে করা এর সবই যে একুশ শতকের আধুনিক মানুষের নিকট তামাদি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণে চোখের সামনে তাদের ঘর-বাড়ি পুড়েছে। এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে হয়েছে তিনজনকে। আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে।
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ইতিহাস মর্যাদা ও সম্ভ্রম রক্ষার ইতিহাস। তাদের উল্লেখ করার মতো সংগ্রামের ইতিহাস আছে। আমরা ১৬০ বছর পূর্বেকার সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাস জানি। তেভাগা আন্দোলনের যোদ্ধাদের রক্ত বহন করছে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম এলাকার ভূমি সাঁওতালদের। পরে পাকিস্তান আমলে সরকার জমি অধিগ্রহণ করে চিনিকলকে বরাদ্দ দিয়েছে। কথা ছিল যে উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে তাছাড়া অন্যকোনো উদ্দেশ্যে এ জমি ব্যবহার করা হলে সরকারের নিকট তা ফেরত দেওয়া হবে। সরকার যেন তা সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর নিকট হস্তান্তর করতে পারে। চিনি উৎপাদন ব্যবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় সাঁওতাল জনগোষ্ঠী আখ চাষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। চিনি কলটিও বন্ধ হয়। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষ কারসাজি করে চিনি উৎপাদন দেখান যাতে সাঁওতালদের নিকট জমি হস্তান্তর করতে না হয়।
বিখ্যাত বাউল সঙ্গীত শিল্পী পবন দাস বাউল সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে তার গানের প্রথম দু’লাইনে বলেছেন, ‘আমায় সাঁওতাল করেছে ভগবান গো। আমায় মানুষ করেনি ভগবান।’ আসলে গানে বলা হচ্ছে, সাঁওতালদের সৃষ্টিকর্তা মানুষ করেনি। পবন দাস বাউল সাঁওতালদের হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে জমে থাকা কষ্টের কথা বলেছেন। আমরা যারা মানবাধিকারের কথা বলি, যারা মানবতার কথা বলি তাদের কর্তব্য সাঁওতালদের এ কষ্ট লাঘবে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।