জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদন : ৬ দফা সুপারিশ নাসিরনগরে হামলাকারী ও পরিকল্পনাকারী শনাক্ত হয়নি
আনিসুর রহমান তপন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার পরিকল্পনায় কারা ছিল এবং কারা হামলা করেছে তাদের পরিচয় নিশ্চিত না করেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেওয়া প্রতিবেদনটি আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
তৌহিদী জনতার নামে পাশাপাশি দুটি পৃথক স্থানে সমাবেশে অংশ নেওয়া লোকজন হামলা করেনি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নৌকা ও ট্রাক দিয়ে বাইরে থেকে এসে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করে অপরাধীরা। হামলাকারীদের শনাক্ত করতে না পারলেও তাদের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বলে উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের লক্ষ্যে এ হামলা করা হয়।
তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা মোকাবিলায় ৬টি সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকে বিতর্কিত যে ছবি পোস্ট করা হয় তার প্রকৃত পোস্টকারীকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। হামলাকারী এবং যারা নেপথ্যে ছিল তাদের শনাক্ত করা, ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্দির হিন্দুপাড়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও প্রশাসনের সমন্বয়ে মতবিনিময় সভার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, হামলাকারীদের ট্রাক দিয়ে ঘটনাস্থলে আনার জন্য ট্রাক ভাড়ার অভিযোগে বিল্লাল মিয়া নামের একজনকে গ্রেফতারের পর তার স্বীকারোক্তিতে জানা গেছে বাইরে থেকে হামলাকারীরা নাসিরনগরে এসেছিল।
স্থানীয় রসরাজ দাসের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে উস্কানিমূলক ছবি পোস্ট করায় ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ এই অভিযোগে হামলার সূত্রপাত হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে এরই মধ্যে পুলিশের ফরেনসিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রসরাজ দাসের মোবাইল ফোন থেকে এ ধরনের কোনো ছবির পোস্ট দেওয়া হয়নি। তদন্ত কমিটির কাছে অভিযুক্ত রসরাজ দাস দাবি করেছেন, ওই পোস্টটি তিনি করেননি এবং কে করেছে সেটাও তিনি জানেন না। আর তদন্ত কমিটিও নিশ্চিত করতে পারেনি রসরাজের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে কারা এ ধরনের পোস্ট দিয়েছে।
তদন্ত দলের কাছে প্রত্যক্ষদর্শী দুজন ও স্থানীয় দুজন রাজনৈতিক নেতাসহ একজন শিক্ষক দাবি করেছেন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে এ হামলার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। যদিও প্রতিবেদনে এ দ্বন্দ্বের বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি।
অবশ্য জেলা প্রশাসনের তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, পুলিশ দিয়ে মন্দির রক্ষার চেষ্টা হলেও তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। তবে গুরুত্ব ও পারিপার্শিকতা বিবেচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের অধিকতর সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে গত ৩০ আগস্ট ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দুটি পৃথক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের জন্য এর আগেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে রাখে সংশ্লিষ্টরা। সমাবেশের দিন কয়েকশ লোক মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা করে। এ ঘটনায় অগ্নিসংযোগসহ লুটপাটও করে হামলাকারীরা। পরে আরও কয়েক দফায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয় সেখানে।
ওই ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিসি) মোহাম্মদ সামছুল হককে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার মাশুকাতে রাব্বি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রাজন কুমার দাস।
নাসিরনগরের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, তিনি নাসিরনগরের দোকানে হামলার খবর পেলেও মন্দির ভাঙা বা বাড়িতে হামলা হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেননি। কমিটির কাছে নাসিরনগর থানার ওই সময়ের ওসি আব্দুল কাদের বলেছেন, ঘটনার দিন তিনি কর্মস্থলে ছিলেন না।
তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি ফাইডিংস ও মন্তব্যের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ঘটনার আগের সন্ধায় উপজেলা সদরে টেম্পুতে চড়ে মাইকিং করে ‘তৌহিদী জনতার’ সমাবেশে যোগদানের জন্য আহ্বান করা হয়। তবে সেই মাইকিংকারী কারা তাদের শনাক্ত করা হয়নি প্রতিবেদনে।