মূলধন ঝুঁকিতে এক ডজনেরও বেশি ব্যাংক
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক: সরকারের নানা উদ্যোগের পরও মূলধন ঘাটতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো। ঝুঁকি এড়াতে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চের শেষে সরকারি খাতের পাঁচ ব্যাংকে (সোনালী, রূপালী, বেসিক, বিকেবি, রাকাব) ১৩ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর বাইরে বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, আইএফআইসি, প্রিমিয়ার ব্যাংক এবং সরকারি খাতের অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত মূলধন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ হারে অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া ঝুঁকি এড়াতে পর্যায়ক্রমে মূলধন সংরক্ষণের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে ব্যাংকগুলোকে। ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুযারি থেকে ওই ১০ শতাংশের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরও দশমিক ৬২৫ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ১৩ ব্যাংক উল্লেখিত পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর থেকে অতিরিক্ত দশমিক ৬২৫ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অগ্রণী ব্যাংক করেছে দশমিক ১৯ শতাংশ, জনতা ব্যাংক করেছে দশমিক ১৩ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংক দশমিক ২৭ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক দশমিক ১১ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংক দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। আর সোনালী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক, প্রিমিয়ার, বিকেবি ও রাকাব কোনো অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। নীতিমালা অনুযায়ী, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বলতে ব্যাংকের যেসব ঋণ ও সম্পদ মান খারাপ হয়ে গেছে, সেগুলোকে বোঝানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ি, ঝুঁকি এড়াতে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৮ ব্যাংক সেই পরিমাণ মূলধনও সংরক্ষণ করতে পারেনি। ব্যাংকগুলো হলো সোনালী, রূপালী, বেসিক, বিকেবি, রাকাব, কমার্স, প্রিমিয়ার ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনও ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না।
এদিকে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলেও ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনো ব্যাংকগুলো হিসাবটা বুঝতে পারেনি। এ কারণে তাদেরকে আরও কিছু সময় দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে নতুন অর্থবছরের বাজেটে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা করা হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতির জন্য প্রধানত দুর্নীতি ও অনিয়মই দায়ী।’
তিনি বলেন, ‘লুটপাট ও অনিয়মের কারণে এই ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি হয়েছে। অথচ সরকার দুর্নীতি বন্ধ না করে এই ব্যাংকগুলোকে আরও অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে।’
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে ২ হাজার ২৩৬ কোটি হয়েছে। গত ডিসেম্বরে এই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৭৭৭ কোটি।
মার্চ শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে এই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংকের এখন মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে ৪৪৪ কোটি টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি এখন ৭৮৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর বাইরে বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৭৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগের প্রান্তিকের মতোই বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ২৯৪ কোটি ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে এক হাজার ৪৩১ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে।
সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১৩টি ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি থাকলেও অধিকাংশ ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মূলধন রাখতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে সামগ্রিকভাবে মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণ করা হয়েছে ১০ শতাংশের ওপরে। গত মার্চে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৭৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে সব ব্যাংক মিলে সংরক্ষণ করেছে ৭৫ হাজার ৬১২ কোটি টাকা, যা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ। অবশ্য ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৭২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা প্রয়োজনের বিপরীতে ব্যাংকগুলো রেখেছিল ৭৫ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা, যা ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সাল থেকে ব্যাংকগুলোর জন্য ব্যাসেল-৩ নীতিমালা কার্যকর হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের মোট সাড়ে ১২ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে।