বন্দীজীবনের অবসান ঘটেছে মান্নার
রিকু আমির, কেরাণীগঞ্জ থেকে: অবশেষে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। যাকে ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আটক করে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনা উস্কানির পৃথক দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটক থেকে বাইরে ডান পা রাখেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এ সময় তার সঙ্গে আনন্দ অশ্রুসিক্ত প্রথম আলিঙ্গন ঘটে আপন চাচাত ভাই বাদশার। এরপর পাঞ্জাবি, পায়জামা, হালকা শীত বস্ত্র, গলায় কালো চাদর ঝুলানো, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা ও পায়ে কালো চামড়ার স্যান্ডেল পরিহিত মান্নাকে ঘিরে ধরেন নাগরিক ঐক্যের অন্তত অর্ধশত নারী-পুরুষ নেতাকর্মী। মুহূর্তের মধ্যে আস্ত গোলাপ, গোলাপের পাঁপড়ি, হলুদ-কমলা রঙের গাঁদা ফুলের মালা-পাঁপড়িতে ভরে উঠেন মান্না। আবেগতাড়িত বিভিন্ন বয়সী নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলিঙ্গন করতে করতে পায়ে হেঁটে আসেন প্রায় ১০০ গজ দূরে। এখানে অপেক্ষারত ছিল- সাবেক সংসদ সদস্য ও নাগরিক ঐক্যের উপদেষ্টা এসএম আকরামের প্রাইভেট কার। এতে চড়েই সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে কারাগার এলাকা ত্যাগ করে রওয়ানা হন ঢাকার গুলশানে অবস্থিত নিজ বাসভবনে।
রাত নয়টার দিকে মান্না বাসায় পৌঁছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা আতিকুর রহমান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ সময় তার পরিবারে আনন্দময় দৃশ্যের অবতারণা হয়। হাসি, আবেগ, চঞ্চলতা ছাড়াও যে আনন্দের সঙ্গী ছিল অশ্রুও।
মান্নার বাসায় স্ত্রী মেহের নিগার ছাড়া আর কেউ নেই। মুক্তি লাভ উপলক্ষে কিছু অতি নিকট স্বজন এসেছেন। এ দম্পতির দুই সন্তান, একজন ছেলে ও একজন মেয়ে- উভয়েই উচ্চতর পড়াশোনারত কানাডায়। এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে মান্নার কথা হয়ে গেছে বলে জানা যায়।
মান্না রোববারই জামিনে মুক্তি লাভ করছেন- এমন কথা ছিল প্রকাশ্য। কিন্তু রোববারেই মুক্তি লাভ না করতে পারার আশঙ্কা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। কারণ, জামিনের নথি ছিল ভুলে ভরা। বিশেষ করে- তার নাম মাহমুদুর রহমান মান্নার পরিবর্তে লেখা ছিল মাহবুবুর রহমান মান্না বলে জানান দলটির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক শহীদুল্লাহ কায়সার।
এ ছাড়াও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জামিনের নথিপত্র পৌঁছতে দেরি, অফিস টাইম শেষে কারাগার লক আপ বন্ধ- এসব জটিলতায় পড়ে রোববার রাতেই মান্নার মুক্তিতে অনিশ্চয়তা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল।
অন্যদিকে, মান্নার বিরুদ্ধে মামলা দুটি। দুটিতেই পাসপোর্ট জমা রাখার শর্তে জামিন দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী- দুই মামলার কপিতে পৃথকভাবে পাসপোর্ট যুক্ত করার বিধান। কিন্তু মান্নার পাসপোর্ট একটি, মামলা দুটি। এটা নিয়ে দায়রা জজ আদালতে জটিলতা দেখা দেয়। পরে এটি সমাধান সম্ভব হয় অনেক সময় ব্যয়ের পর। এসব কারণে বিকাল পৌনে পাঁচটার দিকে জামিনের নথি কারাগারে পৌঁছে। ততক্ষণে কারাগারের লক আপ বন্ধ হয়ে যায়।
ওদিকে, দলের প্রধানকে বরণ করে নিতে বিকাল ৪টা থেকে কারা প্রাঙ্গণ ছিল মুখরিত। শেষ পর্যন্ত কারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিশেষ বিবেচনার সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুক্তি পেতে সক্ষম হন মান্না। রোববার দুপুরে নাগরিক ঐক্যর কেন্দ্রীয় নেতা শহীদুল্লাহ কায়সার বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জামিনের নথিগুলোর ত্রুটি সংশোধন শেষে রোববার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পর্ব শেষ হয়। নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা আতিকুর রহমান বলেন, আপতত তাকে বাসায় নেওয়া হবে। দু-একদিনের মধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।
সম্প্রতি নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার অংশ হিসেবে মান্নাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে স্থানান্তর করা হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। পূর্ব থেকে তিনি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস, দৃষ্টি শক্তির সমস্যা, ব্যাক পেইনসহ নানান শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত। কারাবন্দী থাকাবস্থায় বেশ কয়েকদফা তার চিকিৎসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।
কারাগার প্রাঙ্গণে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা জিল্লুর আহমেদ চৌধুরী দীপু, আহমদ শাহী, খন্দকার সেলিম, প্রফেসর এনামুল হক, মোমেনুল ইসলামসহ অনেকেই। পাসপোর্ট জমা রাখার শর্তে গত ২৮ নভেম্বর জামিন পান নাগরিক ঐক্যর আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে দায়ের করা দুটি মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া জামিনাদেশ সেদিন বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি এসকে সিন্হার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ আদেশটি দিয়েছিল।
তবে দুই মামলার একটিতে তারিখ ভুল ও আরেকটিতে জামিনসংক্রান্ত বিষয়ে কিছু অস্পষ্ট কথা ধরা পড়েছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে নথি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যাওয়ার পর। প্রথমে ধরা পড়ে তারিখের ভুল ও পরে নতুন করে দ্বিতীয় ভুলটি ধরা পড়ে। সংশোধনের জন্য দায়রা জজ আদালত নথিগুলো ফেরত পাঠিয়েছিল আপিল বিভাগে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্য একজন ব্যক্তির সঙ্গে মান্নার ভাইবারে কথোপকথনের দুটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ হয়। গুলশান থানায় ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। ওই বছরের ৫ মার্চ সেনা বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম