সেবা বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার নাগরিক তিন শতাধিক জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত
দেলওয়ার হোসাইন : গত আড়াই বছরে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে তিন শতাধিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন। আরও শতাধিক প্রতিনিধি বরখাস্ত হওয়ার আতংকে রয়েছেন। অনেকে মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। এর মধ্যে বরখাস্ত হয়েছেন- ৪ জন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও ৪৪ জন কাঊন্সিলর, ২১ জন পৌর মেয়র ও ৪৪ কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান ৪৭ জন, ভাইস চেয়ারম্যান ৫৮ জন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ৮৬ ও মেম্বার ৫৪ জন। স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দিনাজপুরে ১৮ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩, সাতক্ষীরায় ১৮, কক্সবাজারে ১৯, বগুড়ায় ২৭, রাজশাহীতে ১৭, কুষ্টিয়ায় ১১, চট্টগ্রামে ১৯, পাবনায় ১২, সিরাজগঞ্জে ৭, গাইবান্ধায় ২৪, রংপুরে ২৩, পিরোজপুরে ৪, হবিগঞ্জে ৭, নাটোরে ৯, জয়পুরহাটে ৫, ঠাকুরগাঁওয়ে ৮, পঞ্চগড়ে ৬, খাগড়াছড়িতে ৩, বান্দরবানে ৪, চাঁদপুরে ৪, ময়মনসিংহে ৩, শরীয়তপুরে ১, নড়াইলে ১, সিলেটে ২ জন এবং মাগুরায় ১ জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এদের অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ভোট কেন্দ্রে আগুন, গাড়িতে পেট্রোল দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, পুলিশের ওপর হামলাসহ রাজনৈতিক সহিংসতার মামলার আসামি তারা। ক্ষমতাসীন দলের বাইরের বাকি জনপ্রতিনিধিরাও মামলাসহ নানা চাপে রয়েছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য। সেবা বঞ্চিত হচ্ছে ওইসব এলাকার নাগরিকরা।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর একজন জনপ্রতিনিধি যদি অপরাধ করেন তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় কেউ চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়ে বরখাস্ত হওয়া মানে ওই এলাকার মানুষকে শাস্তি দেওয়া। এভাবে গণবরখাস্তের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়ছে। স্থানীয় সরকারের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যাকারিতা নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় সরকার আইন পরিবর্তনের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, বরখাস্ত ও গ্রেপ্তারের কারণে জনপ্রতিনিধিরা এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে পারছেন না। আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। এই আইনের পরিবর্তন করা জরুরি বলে দাবি করেন তিনি।
বিদ্যমান স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন), স্থানীয় সরকার (পৌরসভা), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যে কোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (আদালত কর্তৃক চার্জশিট গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পরপর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পরপরই সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। এ সুযোগে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্যানেল মেয়রের তালিকায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে বরখাস্তকৃতদের অনেকে উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে দায়িত্বও ফিরে পেয়েছেন। তবে দায়িত্ব ফিরে পেলেও অনেকেই চেয়ারে বসতে পারছেন না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যদি কোনো জনপ্রতিনিধি অন্যায় কাজ করেন, তাহলে অবশ্যই দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে প্রতিপক্ষ দলের জনপ্রতিনিধিদের হামলা-মামলা বা অন্য কোনো উপায়ে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তা হবে দুঃখজনক। এতে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস উভয়ই নষ্ট হবে। ব্যাহত হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যা ভালো লক্ষণ নয়। এতে নাগরিক সেবা থেকেও বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ।
মহাজোট সরকারের সময় অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়ররা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরই মধ্যে তাদের ৪ জন সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত হওয়ায় গত বছরের ৭ জানুয়ারি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন নাশকতা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে বরখাস্ত করা হয় ৭ মে। তার বিরুদ্ধে আরও ৫টি মামলা চলছে। ১৯ আগস্ট গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানকে বরখাস্ত করা হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে। একই অভিযোগে ২ নভেম্বর খুলনা সিটি মেয়র মনিরুজ্জামানকে বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক মামলা। বিএনপির মনোনীত হওয়ার পরও দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ক্ষমতাসীনদের নানাভাবে ম্যানেজ করে চেয়ার টিকিয়ে রেখেছেন বলে গুঞ্জন আছে। এছাড়া বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের ৪৪ জন কাউন্সিলরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার কোনো জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদি কোনো জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে নাশকতা কিংবা যে কোনো মামলায় চার্জশিট দাখিল এবং তা আদালতে গৃহীত হয়, তখন সেই জনপ্রতিধিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে অনেকেই উচ্চ আদালতের দারস্থ হয়ে বরখাস্তের স্থগিতাদেশ নিয়ে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছেন। সম্পাদনা: এনামুল হক।