সামাজিক আন্দোলনই জঙ্গিবাদকে রুখবে
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
ইসলামি খেলাফতের স্বর্ণযুগের দিকে তাকালে দেখা যায়, অস্ত্র দিয়ে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সে সময় ইসলাম শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল। মুসলমানরা গ্রিকদের জ্ঞান আরবিতে ভাষান্তর করে এবং ইউরোপীয়রা সেটিকে আবার ইংরেজিতে রূপান্তরিত করে।
পৃথিবীর সব ধর্মেই মৌলবাদী রয়েছে। তারা বিজ্ঞানকে দূরে ঠেলে দিয়ে অন্ধকারকে বেছে নিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে যারা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেÑ তারা অন্ধকারের বাসিন্দা। তাদের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নেই, বিজ্ঞানের তো নেই-ই। তারা মতাদর্শ জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য অস্ত্র ব্যবহার করছে। একই ঘটনা আমরা পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও দেখেছি। মাওবাদী চরমপন্থিদের সঙ্গে চীন এবং উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক ছিল। এখন যেমন আইএস, আল-কায়েদাকে আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। তেমনি মতাদর্শ এবং শ্রেণিশত্রু খতম করার জন্য রাতে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘুড়ে বেড়ানো এমন অনেক সংগঠন এই উপমহাদেশে ছিল।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান এবং সাম্প্রতিককালে বিদেশি, শিয়া, লেখক, প্রকাশকদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো খুব হতাশাব্যঞ্জক। এগুলো একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। শিশু-কিশোর সংগঠন, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-সহ নানা সামাজিক কর্মকা-ে যুবকদের জড়িত করতে হবে। মুক্তমনা হওয়ার জন্য মানুষের যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে, সেগুলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সামাজিক সংগঠনসমূহের শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
বেহেশত পাওয়ার জন্য আত্মঘাতী বোমা মারা সম্পূর্ণরূপে কুরআনে নিষিদ্ধ। এসব কাজের মাধ্যমে বেহেশত পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো সে দোজখে যাবে।
শিশু-কিশোররা যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে তার ওপর নির্ভর করে তারা ভবিষ্যতে কি হবে। জঙ্গিবাদ দমনের পদক্ষেপ হিসেবে তাদের বেড়ে ওঠা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদী অংশ হিসেবে পুলিশ, র্যাব এবং গোয়েন্দাসংস্থা দিয়ে নজরদারি করতেই হবে। যাতে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারেÑ সেজন্য আমাদের প্রচেষ্টা থাকতে হবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জঙ্গি সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক লেনদেন রয়েছে। আর্থিক লেনদেন কিভাবে হয়, কোন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে তারা সুবিধা পাচ্ছে, তা নির্ধারণ করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা খুব জরুরি। মনে রাখতে হবে, সবকিছুর মূলে আর্থিক বিষয় জড়িত আছে। আমাদের দেশে বর্তমানে রাজনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলোÑ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে আমরা দেখলাম, সবাই এর পক্ষে নেই। কেউ কেউ বলে, আমাদের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি দোদুল্যমান অবস্থায় ভুগছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তারা কোন পক্ষে? তাদের সুর ছিলÑ ‘আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, তবে সেটা আন্তর্জাতিক মানদ-ে হতে হবে’। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক লবিস্টরা যেভাবে কথা বলেছে, বিএনপিও ঠিক একইভাবে কথা বলেছে। এখন জানা গেল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যাতে না হয়, সেজন্য বিএনপি আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করার জন্য অর্থও ব্যয় করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অনেকেই চায় না, বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশে বসবাস করেও, বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও। তারা বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চায়। বিদেশি শক্তিকে সুযোগ করে দেয়, এখানে ধ্বংসলীলা চালাতে। কখন বাংলাদেশের এমন বিধ্বংসী ঘটনা ঘটছে, যখন বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে। যখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও বেগবান হচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির পথে।
এই জঙ্গিবাদকে প্রতিহত করতেই হবে। উন্নয়নের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই এই জঙ্গিবাদকে দমন করতে হবে।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন