যৌথবাহিনীর অভিযানে ৬ জঙ্গি নিহত ১ আটক, মোট নিহত ২৮, উদ্ধার ১৩ রাতেই ২০ বিদেশীর গলাকাটে জঙ্গিরা
আজাদ হোসেন সুমন ও মাসুদ আলম : ১২ ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধ ও অভিযানের পর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিকে জঙ্গিমুক্ত করেছে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর একটি কমান্ডো দল। এই অভিযানে ২ জন জাপানি ও একজন শ্রীলংকান নাগরিকসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে রেস্তরাঁয় রাতেই জঙ্গিরা গলাকেটে ও কুপিয়ে ২০ জন বিদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে। এরমধ্যে ৯ জনই ইতালির নাগরিক বলে জানিয়েছেন, ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো জেন্টেলোনি।
ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও বলেছেন, তাদের দেশের একজন কিশোরী এই তালিকায় রয়েছে। পুরো অভিযানে জঙ্গিসহ নিহত হয়েছে ২৮ জন। আহত হয়েছেন পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৪০ জন। অভিযান শেষে প্রেসব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাইম আশফাক চৌধুরী জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘থান্ডার বোল্ট’ নামের সফল অভিযানে ৬ জঙ্গি নিহত হয়েছে। ১৩ জনকে যৌথ বাহিনী জীবিত উদ্ধার করেছে এবং ১ জঙ্গি সদস্যকে জীবিত গ্রেফতার করেছে যৌথ বাহিনী। তাদের এই অভিযান করতে সময় লেগেছে মাত্র ১৩ মিনিট। তিনি জানান, নিহতদের সম্মিলিত সারিক হাসপাতালে রাখা হয়েছে। সেখানেই তাদের পোস্টমর্টেম করা হবে। তিনি ঘটনার বর্ণনায় বলেন, সরকার প্রধানের নির্দেশে এই অভিযান চালিয়েছেন। তবে সেনাবাহিনীর এই বক্তব্যে স্থানীয় কয়জন নিহত হয়েছেন সে তথ্য দেয়া হয়নি। এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পপতি লতিফুর রহমানের নাতি এই ঘটনায় নিহত ও আরও দুজন শিল্পপতির দুই সন্তান নিহত হয়েছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চারপাশ থেকে রেস্তরাঁটি ঘিরে রাখে। রাতেই জঙ্গিরা বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে। হত্যার আগে সবাইকে দোয়া-দরুদ পড়তে বলা হয়। যারা কোরানের আয়াত বা সুরা পড়েছে-তাদের ১৩ জনকে আলাদা একটি কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। এরপর মূল কক্ষে ২০ বিদেশি একে তরবারি দিয়ে জবাই হত্যা করা হয়। প্রত্যেকটি জবাইয়ের সময় তারা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে রেস্তরাঁটি মুখরিত করে। রাতভর আশপাশ এলাকায় থমথমে অবস্থা ও আতঙ্ক বিরাজ করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি নেয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), নৌবাহিনীর কমান্ডো এবং বিশেষ বাহিনী সোয়াট।
সকাল ১১টায় অপারেশ ‘থান্ডার বোল্ট’ সফল হয়েছে বলে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে করে মৃতদেহগুলো নেয়া হয় বনানীর নৌবাহিনীর সদর দফতরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে আটককৃত ১ জঙ্গিকেও তারা কড়া নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে নিয়ে যায়। নিহত জঙ্গিদের লাশ নিতে কেউ গতরাত পর্যন্ত যোগাযোগ করেনি।
নিহত জঙ্গিদের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। জঙ্গিরা প্যান্ট-শার্ট পরা ছিল। তাদের হাতে তরবারি, আর্জেস গ্রেনেড ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।
অভিযানের আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধান, পুলিশের আইজিপি ডিজি র্যাব ও পুলিশ কমিশনারসহ দেশের সকল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুপুর ১২টার দিকে সিআইডির ক্রাইম সিনের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করেন। এ সময় সেখানে ডিআইজি প্রশাসন বিনয় কৃষ্ণ বালার নেতৃত্বে অপর একটি টিম ঘটনাস্থলে যায়। এ ব্যাপারে দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে বিনয় কৃষ্ণ বালা বলেন, অভিযান সফল হয়েছে। তিনি ঘটনাকে মর্মান্তিক ও দুঃখজনক বলেও উল্লেখ করেন।
ক্রাইম সিনের একজন কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু এটি একটি বড় স্পর্শকাতর ঘটনা। তাই এটার আলামত সংগ্রহ করাটা একান্ত জরুরি। যেকোনো সময় যে কারও ডিএন টেস্ট করার প্রয়োজন পড়তে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল একটি অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো সংঘটিত রুদ্ধশ্বাস জিম্মি পরিস্থিতি সামাল দেয়ার বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, গত শুক্রবার রাতে গুলশানের আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গিরা সেখানে অবস্থানরত দেশি ও বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র্রে চারলেনে উন্নীত করা ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণ উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের (পুলিশ) উপস্থিতির জন্যই সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। তারা সেখানেই আটকা থাকে। এর মাঝেই আমরা সেনাবাহিনীকে ডাকি এবং সেনাবাহিনীর প্রথম প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন, সিলেট থেকে সে ব্যাটালিয়ন আনা হয়। সাভার থেকে কমান্ডো, ক্যান্টনমেন্ট থেকে কমান্ডো নিয়ে আসা হয়। সেই বাহিনী সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পুলিশ, র্যাব, বিজিবি তারাও সেখানে প্রস্তুত থাকে এবং এই সন্ত্রাসীদের দমন করার, এদের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর পরিকল্পনা আমরা নিই। এগুলো করতে করতে রাত যখন চারটা, তখন সকলে মিলে সমগ্র পরিকল্পনা গণভবনে বসেই নিই, কীভাবে অপারেশনটা চালানো হবে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘১০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগেনি। তার আগেই আমরা জিম্মি করে রাখা সন্ত্রাসীদের উপর আক্রমণ চালাতে সক্ষম হই এবং যারা জিম্মি ছিল এমন ১৩ জনকে বাঁচাতে পেরেছি। বাকি কয়েকজনকে হয়তো বাঁচাতে পারিনি। কয়েকজন আহতাবস্থায় সিএমএইচে চিকিৎসাধীন আছে। যারা সন্ত্রাসী, তাদের ছয়জনই ঘটনাস্থলে মারা গেছে, একজন ধরা পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা সফল অপারেশন করার জন্য আমি আমাদের প্রথম প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে অভিনন্দন জানাই আমাদের সেনাবাহিনী, নেভি, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, বিমানবাহিনী সবাইকে। কারণ সকলে একত্র হয়ে সারা রাত কষ্ট করে এই অপারেশনটা সফল করেছে। সকলে মিলে অপারেশন চালানোর ফলেই আমরা এই স্বল্প সময়ের মধ্যে সন্ত্রাসীদের খতম করতে সমর্থ হয়েছি। সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ দত্ত