নারীদের মাটিতে পুঁতে ফেলা, পুরুষদের আকাশে তুলে ফেলার চর্চা আর কতদিন?
জান্নাতুন নাঈম প্রীতি
ফেসবুক নামের জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমটিতে দেখলাম একজন তার স্ট্যাটাসে চ্যালেঞ্জ করেছেনÑ আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে কি এমন কোনো মেয়ে আছে যে ভ্রুপ্লাক করে না? এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন, ভ্রুপ্লাক কি পরিমাণ বীভৎস জিনিস, কি পরিমাণ ব্যথা লাগে, সর্বোপরিÑ এ কালের মেয়েরা কি পরিমাণ আর্টিফিশিয়াল হয়ে যাচ্ছে… ইত্যাদি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো শুধুমাত্র মেয়েদের ঘিরে লেখা দেখেই আমি আশ্চর্য হয়েছি! যেন মেয়েরাই কেবল ভ্রুপ্লাক করে, ছেলেরা কেউ দাঁড়ি কামায় না। মেয়েরাই কেবল বিউটি পার্লারে যায়, ছেলেদের সেলুন-টেলুন একেবারে উঠে গেছে সব।
প্রত্যেক যুগে ‘ট্রেন্ড’ বলে একটা বিষয় আছে। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ‘ফ্যাশন ট্রেন্ড’। আশির দশকে, ষাটের দশকে বা নব্বইয়ের দশকে আমাদের নানী, খালা আর মায়েদের অর্থাৎ একেক জেনারেশনের গেটাপ-মেকআপ একেক রকমের। ঠিক তেমনই সেসবকালের পুরুষদের শার্টের কলার, চুলের স্টাইল, প্যান্টের মাপ… প্রতিটির আলাদা আলাদা ট্রেন্ড ছিল। জনপ্রিয় নায়ক নায়িকাদের নামেও নানা কাট ছিল। যেমনÑ সুচিত্রা কাট, উত্তম ছাট, ববিতা কাট, সুবর্ণা গলা, এমনকি নায়ক জাফর ইকবাল বা বুলবুল আহমেদের হেয়ার স্টাইল, প্যান্টের বেলবটমও। এগুলোর কথা এলো না, বরং এলো একালের মেয়েদের পাউট ফেস, নিখুঁত হয়ে ওঠার মেকাপের ফ্যাশন, সর্বোপরিÑ গেল গেল, কিশোরীরা হারিয়ে গেল টাইপের একটি রব।
সৌন্দর্যচর্চা খুবই ব্যক্তিগত বিষয়, ধর্মবিশ্বাসের মতোই। কেউ সাজবে নাকি সাজবে না, সাজলে কীভাবে সাজবে, কতটুকু সাজবেÑ এগুলোও অতি ব্যক্তিগত। আমি নিজে ভ্রুপ্লাক করি। চুলে তেল দিই, শ্যাম্পু দিই, ঠোঁটে লিপপ্লস দিই, মুখে পাউডার দিই। শাড়ি পরি, আবার শার্টও পরি। সোজা কথায় আমি একালে আমার সমস্ত পছন্দের ট্রেন্ড মেইন্টেইন করি। এই ট্রেন্ড মেইন্টেইনেও কারোর ভূমিকা নেই। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছে। কোনো পুরুষের ইচ্ছেতে রঙ মেখে সং সাজি না। বরং নিজের ইচ্ছেতে সাজি। যেখানে আমার ইচ্ছেই সব, সেখানে ইচ্ছের গলায় দড়ি পরাতেÑ হু দ্য হেল আর ইউ?
হারিয়ে যাবার প্রশ্নে শুধু কিশোরীদের আর মেয়েদের কথাই কেন বারবার বলা হয়? কিশোররা কি বদলে যায়নি? তারা যে চুলে জেল মেখে, নাকে শিশা টেনে, কানে রিঙ আর গলায় মালা পরে, চোখে সানগ্লাস পরে, থুতনিতে ম্যাগনেট লাগিয়ে কিশোর না সেজে পুরুষ সাজার চেষ্টায় নিমগ্নÑ তা একবারও মাথায় এলো না? রবিঠাকুর নিজেই আলাদা একটা ট্রেন্ড বাঙালিকে দিয়ে গেছেন। ঠাকুরবাড়ির পোশাক নিয়ে ইন্দিরা দেবীর লেখা ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ বাঙালির ফ্যাশন ট্রেন্ডের দলিল।
ইকোনমিকসে ‘আর্টিফিশিয়াল ডিমান্ড ক্রিয়েশন’ অর্থাৎ ‘মেকি জিনিসের সৃজনশীল পরিব্যপ্তি’ বোঝার আগে প্রত্যেক যুগের ‘ট্রেন্ড’ ব্যাপারটা বোঝা উচিত। ট্রেন্ডের সঙ্গে মিলতে চায় প্রতিটি ছেলেমেয়েই। ছোটবেলা থেকেই বাবার মতো করে হাঁটা, মায়ের মতো করে লিপস্টিক দেওয়া, বড়বোনের মতো করে বেণী করাÑ মতো মতো করেই শুরু হয় নিজের মতো করে চলার দুনিয়াটির যাত্রা।
সমস্যা তখনই যখন সেটা ক্ষতিকর। তাই ‘ট্রেন্ড’ এর ভালো দিক, মন্দ দিক বোঝা উচিত। ভালোমন্দের ব্যাপারটা বোঝার আগে বোঝা উচিত লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারটা। নইলে খালি কিশোরীদের সাজ-পোশাকেই কেবল কুতকুতি লাগবে, কিশোরেরা থেকে যাবে কুতকুত খেলার বাইরের মাঠে। খারাপের সংজ্ঞা দিতে হলে নারী-পুরুষ মিলিয়েই দেওয়া হোক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিতে যেমন নাৎসি বাহিনীতে থাকা পুরুষ অকর্ম করেছে, নাৎসি নারীও তেমনই কুকর্ম করেছে। ম্যানহাটন প্রোজেক্টের মতোন গোপন অমানবিক প্রোজেক্টে যেমন ডজন ডজন পুরুষ বিজ্ঞানী ছিল, নারী বিজ্ঞানীও ছিল। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও পুরুষের পাশাপাশি নারী রাজাকারের সংখ্যাও কম নয়।
গালি বা তালি দিতে হলে মিলিয়েই দেওয়া হোক। নারীকে আলাদা করে তুলে রাখাও ওই পাতালে পুঁতে ফেলার মতোই পার্থক্যহীন। দুটোতেই নারীকে পুরুষ থেকে, নারীকে মানুষ থেকে আলাদা করে ফেলার প্রয়াস। ওই পুরুষতন্ত্রেরই আধুনিক ও আলাদা রূপ। মেয়েদের, কিশোরীদের, সর্বোপরিÑ নারীদের মাটিতে পুঁতে ফেলা আর পুরুষদের আকাশে তুলে ফেলার চর্চা আর কতদিন? রবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’র একটা পছন্দের উক্তি আছে আমার। ‘ফ্যাশনটা হচ্ছে মুখোশ আর স্টাইলটা মুখশ্রী’। যে মুখ আর মুখোশের পার্থক্যই বের করতে পারেনিÑ তার মুখে মুখোশের দোষও মুখ পায় না! সে পুরুষ কি নারী বলল তাতে যায় আসে না। যায় আসে শুধু একটিতেইÑ সে কতটা মানুষ হলো?
লেখক ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, মাইক্রোসফট
ফেসবুক থেকে