‘শোক’ যখন ‘সুখ’, মৃত্যু যখন উৎসব
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বসন্ত উৎসব। ভ্যালেন্টাইন ডে। রাজধানী থেকে মফস্বল, রাস্তায় উচ্ছ্বসিত তরুণ-তরুণী, যুবা-যুবতী’র ঢল। উৎসব প্রবণ জাতি উৎসবে মাতোয়ারা। বসন্ত বাতাসে শুধুই ফুলের গন্ধ। চারিদিকে সুখী মানুষের ভিড়। অন্তত রমনায়, রাস্তায়, মেলায়, খেলায় তাই মনে হয়। আর সে মনে হওয়াকে মনে রেখেই আজকের লেখাটির শেষ হয়তো হতে পারত আনন্দধারায়। কিন্তু হবে কি?
বসন্ত এলেই আমার মনের মধ্যে জেগে ওঠে ‘আটই ফাল্গুন’। মনে পড়ে যায় কষ্টগাঁথার এক অনন্য ইতিহাস। মনে পড়ে যায় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ আজ একুশে। ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ ভালোবাসার উৎসবে মনে পড়ে যায় জাফর, জয়নাল, দিপালীর রক্তাক্ত মুখ। মনে পড়ে যায় ১৯৮৩’র সেই উত্তাল দিন। মনে পড়ে যায় লাশের স্তুপ সামনে রেখে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের শুরুর দিন, ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’। ক্রমশ আমার কাছে বসন্ত উৎসব আর কৃষ্ণচূড়ার রং ফিঁকে হয়ে আসে। ১৪ ফেব্রুয়ারির, ভালোবাসা দিবসে গোলাপের চেয়ে গাঢ় হয়ে যায় জাফরের রক্তভেজা জামা।
ফেব্রুয়ারির শুরুতেই আমরা লিখি ‘শোকের মাস’, আর বসন্ত উৎসবে, ভালোবাসা দিবসে মেতে উঠি আনন্দে। আমরা হাসিমুখে এবং কালো ব্যাজ বুকে একুশের সকালে শহিদ মিনারে ফুল দিতে যাই। একটু পরেই লুট হয়ে যায় শহিদ বেদীর সেই শ্রদ্ধার্ঘ, কম দামের ফুল হিসাবে ফিরে আসে আমাদের হাতেই। আমরা সেই ফুল নিবেদন করি প্রেমিকার করপূটে। ফুলের কী বিস্ময়কর অর্থনৈতিক ‘রিসাইক্লিং’ প্রক্রিয়া। আহা রে! কী ভালোবাসার বৈপরীত্য, কী ‘যাদু বাস্তবতা’!
জাতি হিসেবে আমরা মূলত উৎসবমুখি। অনেকেই বাঁকাভাবে বলেন, ‘হুজুগে জাতি’। আমরা মূলত উৎসবের উপলক্ষ্য খুঁজি, হুজুগে মাতি। আশির দশকেও এদেশে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’র অস্তিত্ব ছিল না। নব্বই দশকে আমরা খুঁজে বের করেছি এই ‘ভালোবাসা দিবস’। তারপর মেতেছি ভালোবাসার নামে ভালোবাসাহীন উৎসবে। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করতে পারেন, ভালোবাসাহীন মানে? বিনয়ে বলি, ভালোবাসার সংজ্ঞাটি কী? টিএসসির সড়ক দ্বীপে যখন ঝঁকঝঁকে প্রেমিকার মেকাপ ঢাকা মুখে ফুঁচকা-চটপটি, নাকি ক্ষুধার্ত কুকুরের পাশে জড়োসড়ো এক কিশোরীর অপেক্ষমান লোভি চোখ! নাকি রাতে যখন হোটেলের উৎসবে আলোকিত ‘ভ্যালেন্টাইন পার্টি’, তখন ক্ষুধার তাড়ণায় সেই কিশোরীর রমনার আলোআঁধারিতে শরীরের পসরা! প্রিয়জন, ভালোবাসা কাকে বলে! ভালোবাসা কী কথিত প্রণয়ের রক্ত গোলাপ, নাকি এক থালা ধবধবে সাদা ভাত।
রাতের প্রথম প্রহর থেকেই সেলফোনে নোটিফিকেশন আসছে, ‘শুভ বসন্ত’ বসন্ত উৎসবের শুভেচ্ছা। একজনকে প্রশ্ন করলাম, বসন্ত উৎসব জিনিসটা কী? উত্তর নেই কোনো! আমিও আজ নিরুত্তর। ইতিহাস কপচাতে চাচ্ছি না। কারণ এখন উৎসবের সময়, সংস্কৃতি রক্ষক সমিতির পান্ডারা মহাতৎপর। একটু বেচাল হলেই বিপর্যয়। আমারও তো ভয় আছে। যেমন ছিল তিরাশির ১৪ ফেব্রুয়ারিতে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনে। যখন লিখছি তখনো সেলফোন নোটিশ করল, ‘বসন্ত জাগ্রত আজ দ্বারে, শুভ বসন্ত’। ভাইরে ভালো! এদেশে ‘কুমড়ো উৎসব’ এখন পালিত হওয়া শুরু হয়নি, তাহলে হয়তো নোটিশ পেতাম, ‘শুভ কুমড়ো উৎসব’। এমনিতেও আমরা সব ‘কুমড়োপটাস’, আর ‘কুমড়ো উৎসব’ চালু হলে তো গেল পুরোটাই।
সম্প্রতি আরেকটি উৎসব চালু হয়েছে আধুনিক সমাজে। সেটা হলো ‘হ্যালোইন’ উৎসব। সোজা বাংলায় ‘ভূত উৎসব’। যদিও এ ‘জিনিস’ এখনো উচ্চবিত্তদের আওতায়, কিন্তু আমাদের অনুকরণ প্রিয়তায় বেশিদিন সেটা আর উচ্চবিত্তের আওতাভুক্ত থাকবে না। প্রয়োজনে আন্দোলনে যাবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজ। ভূত হবার অধিকার কী শুধু উচ্চবিত্তদেরই আছে, নিম্ন আর মধ্যবিত্তদের নেই। ‘ভূত হবার সম্ভাবনা এবং অধিকার’ বিষয়ে যদি সেমিনার করা হয়, তাহলে দেখা যাবে প্রকৃত ভূত হবার অধিকার এবং ভূত উৎসবের অধিকার নিম্ন ও মধ্যবিত্তদেরই আছে। কারণ নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা আত্মার সদগতিতে সমারোহে ‘ক্রিয়াকর্মাদি’র আয়োজন করতে পারে না, যার ফলে তাদের আত্মাদের প্রেতাত্মা হয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যে সম্ভাবনা উচ্চবিত্তদের একেবারেই নেই, তারা মৃতের আত্মার সদগতির জন্য প্রচুর আয়োজন করে। যার কারণে তাদের মৃত্যুও উৎসব হয়ে উঠে। সেজন্যেই সঙ্গত যুক্তিতে ‘ভূত উৎসব’ পালন মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের অধিকার। আগামীতে ‘হ্যালোইন উৎসব’ও ছড়িয়ে যাবে সবখানে। আমরা গেয়ে যাব ‘হীরক রাজার দেশে’র উৎসব সঙ্গীত ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’।
এসব প্যাচালে হয়তো অনেকেরই দেশের বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতোন বিরক্তি উৎপাদন হচ্ছে! হয়তো তারা ভাবছেন ‘সুখে’র দিনে কেন এসব ‘শোকে’র গল্প! বড়ই বিরক্তিকর। বসন্ত উৎসবের সঙ্গে কীসব ‘কুমড়ো উৎসব’ টেনে আনছে। এই লোক সংস্কৃতির বোঝেটা কী! সত্যিই আমি সংস্কৃতির কিছু বুঝি না। যেমন বুঝি না আমার ভাষার মাসের শোকের সংস্কৃতির সঙ্গে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’র সম্পর্ক! যেমন বুঝি না বসন্ত উৎসবের কার্য-কারণ! শুধু বুঝি সব হচ্ছে ‘জগাখিঁচুরি’।
জগন্নাথের মন্দিরে চাল, ডাল, কুমড়ো, ঢেড়শ যে যা শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনত তার সব এক হাঁড়িতে মিলিয়ে ‘ঘুটা’ মেরে যা রান্না হতো, তার নাম বলা হতো ‘জগার খিঁচুরি’। যা থেকে ‘জগাখিঁচুরি’র উদ্ভব। আমাদের দেশের সংস্কৃতিতেও এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার করা জিনিস এনে ‘ঘুটা’ মারার প্রক্রিয়া চলছে। নিজ লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যকে ভুলিয়ে দিতে চলছে সংস্কৃতির নামে, উৎসবের নামে ‘জগাখিঁচুরি’র আয়োজন। আর সেই ‘জগাখিঁচুরি’ খাইয়ে দেশের মানুষকে ‘জগাই’য়ে পরিণত করতে চাচ্ছেন যারা তাদের সম্পর্কে সাবধান হবার সময় এসেছে। সুতরাং সময় থাকতে ‘বাঁচতে হলে, জানতে হবে’ এবং সঙ্গে বুঝতে হবে। তা না হলে মৃত্যুও একদিন উৎসবে পরিণত হবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান