থাইল্যান্ড-মিয়ানমারের সেনাতন্ত্র তাদের বিপরীতমুখী ভূমিকা
ইমরুল শাহেদ : প্রায় এক হাজার আটশ’ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে প্রতিবেশী দুই দেশ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের। কিছু দিন আগেও দুই দেশই চলছিল সামরিক শাসনের অধীনে। তবে মিয়ানমারের বিষয়টি ছিল একটু ব্যতিক্রম। সেখানে সামরিক জান্তা নতুন দল গঠন করে নির্বাচনের মাধ্যমেও ক্ষমতায় ছিল। এই দুই দেশের সেনাতন্ত্রের একটা বিপরীতমুখী ভূমিকা বলতে গেলে প্রকাশ্যেই প্রবহমান আছে। এই প্রক্রিয়া চলছে শুধু হাত বদলের মধ্যদিয়ে। সম্প্রতি মিয়ানমার গণতন্ত্রের দিকে পা বাড়িয়েছে এটা আশার কথা। বিগত কয়েক দশকের সেনা শাসনের পর এখন একটি গণতান্ত্রিক সরকার দেশ শাসন করছে। সেনা শাসকরা সেনানিবাসে ফিরে যেতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে থাইল্যান্ড একসময় ছিল গণতন্ত্রের বাতিঘর। দেশটি এখন অনেক দূর পিছিয়ে গেছে। ২০১৪ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইংলাক সিনাওয়াত্রার নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হয়। থাইল্যান্ড তখন থেকেই এক রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার এবং সেখানে গণতন্ত্র কথাটির কোনো স্থান নেই। থাইল্যান্ডে সামরিক জান্তার উত্থান ও মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রভাব খর্বের খেলাটা চলছে দুদেশের সেনা বাহিনীর প্রজন্ম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এই দুই সেনা বাহিনীর পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে বদলে যাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং কিভাবে তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে ধরে রাখা যায় তারও একটা প্রক্রিয়া।
মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি থাইল্যান্ডের জন্য সবক গ্রহণের মত হতে পারে। সেভাবে থাইল্যান্ডে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের উত্তরণও ঘটানো যেতে পারে। মিয়ানমার সামরিক জান্তা বরাবরই উপজাতি বিদ্রোহীদের হাত থেকে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে তাদের নিষ্পেষনের শাসনকে বৈধতা দিতে চেয়েছে। কিন্তু ১৯৮০ সালের দিকে স্টেট ল’ অ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল (এসএলওআরসি) কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তিতে আসার পরই তারা নজর দেয় দেশের একমাত্র বিরোধী শক্তি অং সান সুচির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিকে দমনের দিকে।
১৯৯০ সালের প্রায় পুরোটাই জান্তা ও সুচির ক্ষমতার সমীকরণ নির্ধারণে ব্যয় হয়ে যায়। তবে ইতোমধ্যে এসএলওআরসি নামটিকে আরও কিছুটা নমনীয় করে নাম রাখা হয় স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল (এসপিডিসি)। এটির কাজ হলো জান্তাদের নতুন রাজনৈতিক এজেন্ডা শনাক্ত করা। এর মধ্যে ছিল জান্তাদের প্রতিশ্রুতি মাফিক ২০০৩ সালে গণতন্ত্র কার্যকর করার একটা রোডম্যাপ। ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের সেনা বাহিনীতে প্রজন্মগত ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তরুণ প্রজন্মের সেনারা দেখেছেন উপজাতি বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সঙ্গে কিভাবে শান্তি প্রক্রিয়া বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং কিভাবে দেশটি গণতন্ত্রের দিকে সরে এসেছে। এসব সৈনিকদের অনেকেই বিদেশে সেনা প্রশিক্ষণে গিয়েছেন। সেখানে তারা দেখেছেন সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বটা কি রকম। সিনিয়র জেনারেল থান সুয়ে এবং তার লোকজন আন্তর্জাতিক চাপ ও অবরোধ আরোপের মুখে দমন নীতি বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি। এছাড়া মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদারনীতি এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রায়নের যে তরঙ্গ প্রবাহিত হয় তার তীব্রতর গতির মুখে সেনাবাহিনী রাজনীতি থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়।
২০১১ সালে তরুণ প্রজন্মের সেনা প্রধান জেনারেল মিন অং হেইল্যাং গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়াকে সহায়তা করেছেন। যদিও এখনও পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছেÑ তথাপি ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি ব্যাপক সাফল্য সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে অনেকটাই খর্ব করে এনেছে। অন্য কথায় বলা যায়, সেনাবাহিনী তাদের রাজনৈতিক ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখেই বেসামরিক সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চাইছেন। এখন অন্তত বলা যায় মিয়ানমারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে এবং সেটা সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক দরকষাকষি এবং আপোষরফার কারণেই।
থাইল্যান্ডের পরিস্থিতি কিছুটা ব্যতিক্রম। সেখানে পুরনো প্রজন্মের সেনারাই দৃশ্যপটে রয়েছেন। কুইন্স গার্ডস নামে পরিচিত ২১তম পদাতিক বাহিনীর সেনারাই এখানে স্থান করে নিয়েছে। এ সেনারা না রক্ষণশীল বা তার বাইরেও নয়। দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বলে দেয় কুইন্স গার্ডসরা কেন প্রতিবেশী মিয়ানমারের বিপরীত কাজটা করল। রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজ প্রায় ৭০ বছর দেশটি শাসন করেছেন। এ সময়ে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তারা সম্মিলিতভাবে থাই রাজনীতিকে এমনভাবে পুনর্গঠন করেছিলেন যে, বেসামরিক সরকারের ক্ষমতার চর্চা রাজতন্ত্র এবং সেনাবাহিনীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু এক সময় তার মন্ত্রমুগ্ধ শাসনের অবসান হয়ে যায়। রাজার অনুপস্থিতিতে উচ্চাভিলাষী সেনা শ্রেণিকে ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে এক মতবাদী করে তোলে। ২০০৬ ও ২০১৪ সালের দুটি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা ও তার রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের উৎখাত করে।
সেনাবাহিনী তাদের রাজনৈতিক অভিলাষের পক্ষ সমর্থনে এগিয়ে যায়। এ সময়ে তারা সেনা সমর্থিত প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করে তোলে। এর মধ্যে রয়েছে সিনেট এবং সাংবিধানিক আদালত। এর মধ্যদিয়ে তারা ভবিষ্যৎ বেসামরিক সরকারের সঙ্গে একটা ভারসাম্য গড়ে তোলার কাজ করে যাচ্ছে। কুইন্স গার্ডসের সদস্যরা এখন থাই রাজনীতির হাতেখড়ি নিচ্ছে বলতে গেলে শূন্য থেকেই। তাদের ভয় হচ্ছে, রাজপরিবার পুরোপুরি সরে গেলে সেনাবাহিনী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে কিনা। তাদের ধারণা, থাকসিনের নতুন রাজনৈতিক শক্তি তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেবে।
থাই সামরিক জান্তা মিয়ানমারের এসএলওআরসির মতোই ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর পিস অ্যান্ড অর্ডার (এনসিপিও) গঠন করেছে। এই দুটিরই উদ্দেশ্য অভিন্ন। সেটা হলো রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ফলপ্রসূ আলোচনা না করে ভিন্ন মতাবলম্বীদের কিভাবে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। কিন্তু থাইল্যান্ডের এনসিপিও এখন বলছে তারা মতদ্বৈততা দূর করতে চান। সেখানে এখন ব্যক্তি স্বাধীনতা তিরোহিত। গণমাধ্যম চলছে তীব্র সেন্সরশীপের মধ্যদিয়ে। এমতাবস্থায় রাজদ্রোহ বাড়ছে এবং বাড়ছে রাজতন্ত্রকে অবমাননা করার প্রবণতা।
এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসতে প্রায় কয়েক দশক সময় লেগেছে। সেনাবাহিনীর মূলে রাজনৈতিক পরিবর্তনের শেকড় গজাতে নতুন প্রজন্মের সেনা বাহিনীকে দৃশ্যপটে আসতে হয়েছে। কিন্তু থাইল্যান্ডে এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার কোনো লক্ষণ নেই। দেশটির নতুন রাজা যিনি আসবেন তাকে বড় ধরনের সংকটই মোকাবিলা করতে হবে। সেনাবাহিনীর পুরনো দৃষ্টিভঙ্গির যদি মূলোৎপাটন না হয় তাহলে রাজনৈতিক আপোষরফা সুদূর পরাহতই থেকে যাবে। তাতে থাইল্যান্ডকেও মিয়ানমারের অতীতের ভাগ্যই বরণ করতে হবে।
(কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ-ইস্ট এশিয়ান স্টােিজর অধ্যাপক পবন চাচাভালপংপুনের একটি গবেষণাপত্র অবলম্বনে।)
সম্পাদনা : সুমন ইসলাম