সমর্পিত কুম্ভকরণ এবং বাগিচার নিষ্ঠুর মালিক
সৈয়দ রশিদ আলম
আমাদের অর্থনীতির পাঠকদের এমন দুটি ঐতিহাসিক চরিত্রের কথা জানাব যার মাধ্যমে যে শিক্ষাটা আমাদের অর্জিত হবে, তা হচ্ছেÑ সমর্পণ ও দয়ার মাধ্যমে মুক্তি লাভ। হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ বাল্মিকী রচিত রামায়নে বর্ণিত শ্রীরামের স্ত্রী সীতার হরণকারী রাবণের ভাই কুম্ভকরণ, যিনি শক্তির দিক দিয়ে সবার চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকার কারণে সবাই তাকে ভয় পেত। বেশির ভাগ সময় তিনি নিদ্রায় থাকতেন। যখনই ঘুম থেকে উঠতেন, উত্তেজিত হয়ে যেতেন। সহজে তার ক্ষুধা নিবারণ হতো না। এই কুম্ভকরণ যখন শ্রীরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে নামলেন তখন তিনি অসীম সাহসের পরিচয় দেখালেন। শ্রীরামের অনুসারীরা ভয় পেয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত শ্রীরামের তীর নিক্ষেপের পর কুম্ভকরণের শরীর থেকে দুটি হাত খসে পড়ল, অর্ধেক শরীর খসে পড়ল। এই অবস্থায় তিনি দেখতে পেলেন জগৎ যার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে সেই নারায়ণ ও মহাদেব তার সামনে উপস্থিত। তিনি তাদের দেখে অনুশোচনা করে বললেন, আমার দুটি হাতও নেই যে, আপনাদের নমস্কার জানাব। দুটি চোখ বন্ধ করে আপনাদের প্রতি আমার সমর্পণ ব্যক্ত করছি। নারায়ণ ও মহাদেব কুম্ভকরণকে আশির্বাদ করলেন। শেষ পর্যন্ত কুম্ভকরণ মুক্তিলাভ করলেন।
একমাত্র আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যারা সমর্পিত হবেন তারাই মুক্তিলাভ করবে, যেভাবে কুম্ভকরণ মুক্তি লাভ করলেন। রামায়ণের এই শিক্ষা যদি বাস্তবায়ন সম্ভব হয় মানুষ অন্যায় থেকে দূরে সরে যাবে। পূর্ব ইউরোপের একাধিক দেশে যে ঘটনাটি গির্জায় গির্জায় আলোচনা হয়, ঘটনাটি এ রকম। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া একজন একাকী মানুষ একটি বাগানের মালিকানা পেলেন। সেই বাগানের একাধিক ফলের গাছ রয়েছে। যেহেতু তিনি একা ফল বিক্রি করেন ও নিজে খান, কিন্তু কাউকে ফল দিতে রাজি নন। মানুষের কাছে একজন কৃপণ হিসেবে তিনি পরিচিত। তার বাগানে যে সব ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে আসত তাদের তিনি তাড়িয়ে দিতেন। হঠাৎ একদিন একটি ঘটনা ঘটে গেল, কয়েকজন ছোট ছেলে-মেয়ে চুপি চুপি বাগানে প্রবেশ করল। তারা জানত বাগানের মালিক ঘুমিয়ে আছেন। একজনকে তারা গাছে উঠিয়ে দিলেন, যেন সে সবার জন্য গাছের ফল সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু হঠাৎ করে বাগান মালিকের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বাগানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সব শিশু পালিয়ে গেল। গাছে রয়ে গেল ছোট একটি শিশু।
বাকি শিশুরা দূর থেকে নিষ্ঠুর বাগান মালিকের আচরণ দেখতে লাগল। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন গাছে ছোট একটি ছেলে। ছেলেটিকে দেখে তার ভিতর মায়া তৈরি হলো। গাছ থেকে তিনি তাকে নামালেন। ফলগুলোও নিতে দিলেন। বললেন, এখন থেকে এই বাগানের সমস্ত ফল তোমরা খেতে পারবে। শিশুরা খুশি হয়ে চলে গেল। অবাক হয়ে গেল বাগান মালিকের পরিবর্তিত আচরণ দেখে।
চার বছর পরের ঘটনা, সেই বাগান মালিক অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সেবা বা পানি পান করানোর মতোও কেউ নেই। এমন পরিস্থিতিতে তিনি লক্ষ্য করলেন, যে ছেলেটি তার বাগানের গাছে উঠে ফল পেড়েছিল, সেই ছেলেটি তার সমানে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাকে চিনতে পারলেন। অনুরোধ করলেন, পানি পান করানোর। তার ইচ্ছা শিশুটি পূর্ণ করল। ছেলেটি বলল, একসময় আপনি আমাকে গাছের ফল উপহার দিয়েছিলেন, কোনো শাস্তিই আমাকে দেননি। আপনি বাগিচা পছন্দ করেন। এটাই আপনার পৃথিবী ত্যাগের মুহূর্ত। পরম করুণাময় আপনার জন্য একটি সুন্দর বাগিচা তৈরি করেছেন। আমি সেই বাগিচায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছি। আমাকে বলা হয়, মৃত্যু দূত। যারাই মানুষের প্রতি অনুরাগের আচরণ করবে পরম করুণাময় তাদের প্রতিও দয়া প্রদর্শন করবেন। এই ঘটনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলোÑ দয়া পেতে হলে দয়া প্রদর্শন করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান