আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিএসএমএমইউ-এর লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম আমাদের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা জুড়েই বঞ্চনা ও বৈষম্য চলছে
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক রহমান
স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার পূরণে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। চিকিৎসাসেবার জন্য সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে, কমাতে হবে মানুষের খরচ। চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে যে টানাপোড়েন, যোগাযোগ শূন্যতা তা দূর করতে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী (হেলথ ওয়ার্কার)-দের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার। স্বাস্থ্যসেবাখাত আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে, তবে আরও উন্নতি সম্ভবÑ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম।
তিনি বলেন, চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে গেলে এ খাতের টোটাল ম্যানপাওয়ারকে বিবেচনায় আনতে হবে, সবার কথাই চিন্তা করতে হবে। চিকিৎসক থেকে শুরু করে আমাদের নার্সিং সার্ভিস, ওয়ার্ডবয় সার্ভিস, ক্লিনিং সার্ভিস, লজিস্টিক সার্ভিস সবগুলো বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে একটা অংশ পুঁজিবাদী মানসিকতায় আক্রান্ত। তবে সামগ্রিকভাবে এ কথা যে সত্য তা বলা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা হেলথ সিস্টেমেই ব্যবস্থাপনাগত বঞ্চনা ও বৈষম্য চলছে। যেখানে যার ক্ষমতা রয়েছে সেখানে তিনি সেই অব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করছেন। যেমন ধরুন, গরিব রোগীদের ভালো চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু যাদের সামর্থ্য আছে, দেখা গেল তিনি একইদিনে ৩-৪ জন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিচ্ছেন। এমনটি উন্নত বিশ্বে কল্পনাও করা যাবে না। আমাদের এখানে উন্নত বিশ্বের মতো রেফারেল সিস্টেম প্রবর্তন করা এখন সময়ের দাবি। রেফারেল সিস্টেম প্রবর্তন না করলে কখনোই স্বাস্থ্যসেবার কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাবে না।
ডা. শাহিনুল আলম বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে সব রোগী সমান অধিকার পায় তা নয়। যার সামর্থ্য বেশি তিনি সরকারি হাসপাতালের সুবিধা বেশি নিচ্ছেন, সামর্থ্যহীনরা বঞ্চিত হচ্ছেন। আধুনিক বিশ্বে চিকিৎসার মানউন্নয়ন ও রোগ নির্ণয়ের যে চ্যালেঞ্জ তা মোকাবিলা করার জন্য যে সামর্থ্য থাকা দরকার সেই জায়গায় পৌঁছতে আমাদের আরও সময় লাগবে। সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যেও স্বাস্থ্যখাতে আমাদের অর্জন পৃথিবীতে উদাহরণযোগ্য। আমরা বিগত কয়েক দশকে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে এনেছি। মাতৃ মৃত্যুর হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। চিকিৎসার উন্নতির কারণেই আমাদের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে। আমাদের ইপিআই প্রোগ্রাম প্রতিবেশী যেকোনো দেশের চাইতে সফল। চিকিৎসা খাতে স্বল্প ব্যয় করেও আমরা এতকিছু অর্জন করেছি। আমাদের এই অর্জনের প্রশংসা করেছেন নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন ও মেডিকেলবিষয়ক ব্রিটিশ জার্নাল ল্যানসেট। আশা করা যায়, আমরা ২০৩০ সালের মধ্যেই ভাইরাল হেপাটাইটিস-বি দূর করতে পারব।পুরো পৃথিবী এখন সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদী চিন্তাধারার আলোকে এগোচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন সবদিকে গেঁড়ে বসেছে। এই পুঁজিবাদী ধারায় আমরা যারা কাজ করছি, তারাও পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতায় নামতে গিয়ে রোগীদের সামর্থ্য ও আমাদের দায়িত্ব বিবেচনা না করেই কখনো কখনো নিজেদের আয় রোজগার বৃদ্ধির চিন্তা করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. শাহিনুল আলম বলেন, চিকিৎসাসেবায় চিকিৎসকদের আন্তরিকতা নিয়ে মানুষের যে অভিযোগ তা এককথায় উত্তর দেওয়া যাবে না। এটা যদি আমি দুভাগে ভাগ করে বলি তাহলে এক নম্বর হচ্ছেÑ আমাদের এখানে রোগীর চাপ অনেক বেশি। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে একজন মেডিকেল অফিসারকে গড়ে ১৫০ জনের মতো রোগী দেখতে হয়। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে আরও বেশি রোগীও দেখতে হয়। একদিনে এত রোগী দেখতে গিয়ে মন চাইলেও তিনি তাদের আন্তরিক সেবাটি দিতে পারবেন না। এছাড়া ডাক্তারদের কাছে রোগীদের প্রত্যাশাও বেশি থাকে। কিন্তু চিকিৎসা খাতের সীমাবদ্ধতাগুলো তারা বুঝতে চান না। আমি মনে করি, চিকিৎসকরা শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আন্তরিকভাবেই সবাইকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, অনেক সময় রোগীরা এমন সময় হাসপাতালে আসেন যে তখন আর চিকিৎসকের কিছু করার থাকে না। তারপরও সব দোষ চিকিৎসকের উপরে গিয়েই পড়ে। আমাদের দেশে বিএমডিসি কর্তৃক নিবন্ধিত চিকিৎসক রয়েছেন ৭৮৫৭২ জন (মৃত ও বিদেশে অবস্থারতসহ)। এই চিকিৎসকের সবাই কিন্তু রোগী দেখেন না হয়তো ৪০ হাজার চিকিৎসক রোগী দেখছেন। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য মাত্র ৪০ হাজার চিকিৎসক, সংখ্যাটা খুবই অল্প। এর পাশাপাশি চিকিৎসককে সহায়তা করার মতো দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণের ঘাটতিও ব্যাপক।
তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১৭ কোটিরও বেশি রোগীর ভিজিট ডাক্তারদের সমাধান করতে হয়েছে। আমাদের সরকারি হাসপাতালে ২২ হাজার ৩৭৪ জন ডাক্তার রয়েছে, হয়তো ১৫ হাজার ডাক্তার এই রোগীদেরকে দেখেছেন। আর কর্মদিবস ছিল ২৯৭ দিন। প্রত্যেক চিকিৎকের ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি হিসাব করলে গড়ে প্রতিটি রোগী ৩ মিনিটের বেশি সময় পান না। জনবল ও সামর্থ্যরে দিক থেকে স্বাস্থ্যসেবায় প্রতিবেশীদের তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। সীমিত জনবল নিয়েই ২০১৫ সালে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ৫৭১১৬৪১ ভর্তি রোগীকে, অপারেশন করা হয়েছে ১৭ লাখেরও বেশি আর জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ৭৪২৫৫৪১ জনকে। দেশের ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা দিতে হলে অনতিবিলম্বে আরও ৫০ হাজার চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। অন্যদিকে অনারারি চিকিৎসকরা বিনা বেতন ও ভাতায় টারসিয়ারি লেভেল হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। বিনা বেতনে সেবা দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই। চিকিৎসকদের এমন বঞ্চনার কথা কেউ-ই আলোচনায় আনেন না। এটা সমাধানেরও কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে তরুণ চিকিৎসকদের মাঝে দিনদিন হতাশা বাড়ছে।
দেশের চিকিৎসা ব্যয় বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, চিকিৎসাসেবায় ব্যয়ের বিষয়টি বহুল আলোচিত। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ নিজের পকেটের টাকা খরচ করে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে রোগীরা, ৩৫ শতাংশ অর্থ সরকার বহন করে। আমাদের স্বাস্থ্যখাতের বাজেট হচ্ছে ১৭ হাজার কোটি টাকা আর প্রতিবছর ঔষধ বিক্রি হয় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের চেয়ে বেশি ঔষধ বিক্রি হয়। তাহলে একটা দেশের স্বাস্থ্যসেবার সামর্থ্য কিভাবে বাড়বে, বলুন? মোট বাজেট অনুপাতে আমাদের স্বাস্থ্য বাজেট ৪.৬ শতাংশ। মোট স্বাস্থ্য বাজেট বাড়লেও মোট বাজেটের অনুপাতে আমাদের স্বাস্থ্য বাজেট নিম্নমুখী এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আনুপাতিক হারে কম। আমাদের স্বাস্থ্য বাজেট ন্যূনতম ৩৫ হাজার কোটি টাকা হওয়া প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অনেকেই বিদেশে যান। মানুষের এই বিদেশ যাত্রার প্রবণতা বেশি কেন, জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের এখানে অভ্যন্তরীণ রোগী ট্রান্সফার যেমন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হচ্ছে, বিদেশে যারা যাচ্ছেন সেটাও প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। এটাকে বলা হয় হেলথ ট্যুরিজম। হেলথ ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি এখন সারা পৃথিবীতে ব্যবসার জন্য একটা বিশাল বিষয়। সমান ও একই ধরনের চিকিৎসাসেবার সুযোগ থাকার পরও যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক রোগীদের বিদেশে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য যাওয়ার দরকার নেই। এই সেবা এখানেই আছে। অল্পকিছু ক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চিকিৎসক ও গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব মাঝে-মধ্যে আমরা দেখতে পাই তার বেশিরভাগই ভুল বোঝাবুঝির কারণে হচ্ছে। গণমাধ্যমকর্মীরা পাঠক কাটতির চাইতে বৈজ্ঞানিক সত্য তুলে ধরলে এবং পারস্পরিক তথ্য বিনিময় করলে দূরত্ব দূর করা সম্ভব। চিকিৎসক ও গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক রাখা খুব প্রয়োজন। দেশের মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই এটা খুব দরকার। আমাদের উভয়েরই লক্ষ্য এক। আর তা হচ্ছেÑ জনগণের সেবা করা। জনগণের জন্য কাজ করা। কিন্তু দ্বন্দ্বটা হচ্ছে কোন জায়গায়? অনেক সাংবাদিক এমনভাবে প্রতিবেদন করেন যে, দেখা যায় অনেক জায়গায় বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলছে না। তখন চিকিৎসকদের কেউ কেউ হয়তো বিষয়টি নিয়ে হতাশ হন। এটা মূলত এই হতাশারই বহিঃপ্রকাশ বলতে পারেন।
তিনি বলেন, চিকিৎসকদের মধ্যে ইন্টার্ন ডাক্তাররাই হচ্ছে সবচেয়ে তরুণ। তাদের বয়স কম। গণমাধ্যমের সঙ্গে চিকিৎসকদের যে মনোমালিন্য তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটাচ্ছে এই ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝির কারণেই এটা হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের মধ্যে যেন সুসম্পর্ক থাকে, ভুল বোঝাবুঝি না হয় সে ব্যাপারে উভয় পক্ষকেই সচেতন থাকতে হবে, সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। চিকিৎসক ও সাংবাদিকরা মিলে আমাদের সীমাবদ্ধতা, প্রকৃত সত্য, অবহেলা ও ভুলত্রুটি বের করা সম্ভব বলেও মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।