স্বাধীন ও নতুন ধারার রাজনীতি কবে পাব?
মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম
বাংলাদেশ মূলত একটি গ্রাম। গ্রামীণ জনপদের গতরখাটা কৃষকসমাজ আবহমানকাল ধরে এই দেশকে বুকে-পিঠে করে গড়ে তুলেছে, রক্ষা করেছে। আজকের আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগেও দেশের ভরসা গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষই। অথচ তারাই সবচেয়ে অবহেলিত।
প্রাচীনকালে আর্য-ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীরা এদেশের মানুষকে বলত দস্যু, অসুর, ম্লেচ্ছ, অস্পৃশ্য, অসভ্য ইত্যাদি। মধ্যযুগে মধ্য এশিয়ার মোগল, পাঠান-তুর্কি শাসকরা আমাদের পুর্বপুরুষদের বলত বাঙ্গাল, নেংটিপরা, নিম্নজাত, আতরাফ, আজলাফ ইত্যাদি। ঔপনিবেশিককালে ইউরোপের শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দালাল সাহেব-বাবু সমাজ নাম দিয়েছিল তাদের কুলি-মজুুর, গেঁয়ো, গ্রাম্য ইত্যাদি। বাংলাদেশের জনসমাজ এবং এর ভাষা-সংস্কৃতি জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠেছে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর গড়ে তোলা শাসনকেন্দ্র অর্থাৎ দরবারের বাইরে অনাদরে-অবহেলায়। ফলে জাতির জীবনের পরতে পরতে বাসা বেঁধে আছে পরাধীনতার ঐতিহ্য। গত শতকের ষাটের দশকের ৬ দফা আন্দোলন, গণজাগরণ ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার আজীবন আরাধ্য সেই দরবারের দখল নিল বটে; কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস স্বাধীন দেশে গ্রামীণ জনপদের মানুষদের পল্লীবাসী, লোকায়ত জনসমাজ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ইত্যাদি বিশেষণসূচক পরিচয় নিয়ে তথাকথিত মূলধারা বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই জীবনপাত করতে হচ্ছে। অথচ দেশটির অর্থনীতি বলতে যা বোঝায় তার প্রায় সবটার কৃতিত্ব এই কৃষক সমাজ ও কৃষক ঘরাণার গ্রামীণ মানুষদের। দেশটাকে সমস্যার জালে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছি আমরা শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। আজকে পর-শাসকদের দ্বারা সৃষ্ট পরাধীন তথাকথিত শহর-বন্দর-রাজধানী তোষণনীতি এবং ইউরোপ-আমেরিকা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাতিসংঘ এসবের মুখাপেক্ষিতা জাতিকে অক্টোপাসের মতো আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁেধ রেখেছে। জাতি আজ বিজাতীয় ভাবধারায় দ্বিধাবিভক্ত। ফলে প্রিয় বাংলাদেশ জনগণের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠছে না। এর জন্য দায়ী আধিপত্যবাদী রাজনীতি। আমাদের দুর্ভাগ্য স্বাধীনতা লাভের পঁয়তাল্লিশ বছর পরও এই রাজনীতির পরিবর্তন হলো না।
রাজনীতি মানুষের জীবনের ভিতরের বিষয়। জাতির জীবন সংগ্রাম ও সাধনার ভিতর থেকে রাজনীতি সংগঠিতরূপে বেরিয়ে আসে। সকল জাতির জীবন ও জীবন সংগ্রামের ধারা অর্থাৎ জাতীয়সংস্কৃতি এক ধরনের নয়, ভিন্নতর। ফলে জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও জাতি বিশেষে ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। বিভিন্ন জাতির রাজনীতির পারস্পরিক মিলনের প্রশ্নটি সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার বিষয়। জোরাজুরির প্রশ্ন এখানে আরোপিত এবং অনৈতিক। জাতিসমূহের সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত মিলন ঘটবে কেবল তখনই যখন জাতীয় সংস্কৃতির সুষম বিকাশের মধ্য দিয়ে মানবীয় সংস্কৃতিতে উত্তরণ ঘটবে। জাতীয় সংস্কৃতির সুষম বিকাশ বলতে জাতির অন্তর্গত সকল কিছুর সমানুপাতিক বিকাশকে বোঝাবে। অথচ যুগে যুগে নানা জাতি, সংস্কৃতি, বিদেশি শাসক-শোষক গোষ্ঠীর পালাক্রমিক আধিপত্যবাদী শাসন-শোষণে বাঙালি জাতির স্বকীয় দর্শন-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সাহিত্য এবং রাজনীতিসহ সকল সম্ভাবনা চাপা পড়ে আছে, মাথা তুলতে পারছে না।
বর্তমানের উপর দাঁড়িয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন এবং তার মাধ্যমে দেশ-মানুষ জাতির জীবনকে ভিতর থেকে জাগিয়ে তোলে স্বাধীন ও সমৃদ্ধতর করার সম্মিলিত কর্মপ্রয়াসই রাজনীতি। কিন্তু আমাদের ওপর রাজনীতির নামে যেসব কর্মকা- চাপানো রয়েছে তার সঙ্গে স্বকীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। রাজনীতির অঙ্গনে যেসব অনুসঙ্গ সমাজ, মানুষ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নিয়ত চর্চা করা হয় সেসবের সঙ্গে এদেশের মানুষের জীবন সংগ্রাম তথা সংস্কৃতির তেমন কোনো সংযোগ-সম্পর্ক নেই। ঔপনিবেশিক শাসন সূত্রে এখানে রাজনীতি ও রাজনৈতিকব্যবস্থা আমদানি করা হয়েছে। যেমনিভাবে এদেশে জীবনধারনের জন্য আমদানি করা হয় বিলাতি অন্যান্য পণ্যসামগ্রী। কোনো জাতির স্বাধীন বিকাশ ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদানি করা এ রাজনীতি ও রাজনৈতিক আদর্শ এবং জীবনব্যবস্থা কতটা কার্যকর ও সঙ্গতিপূর্ণ সেই ভাবনা জাতিগতভাবে আমাদের নেই। এখানেই সব সংকটের মূল নিহিত। কাজেই দেশের সামগ্রিক সংকট নিরসনে প্রচলিত ধারার চিন্তা ও কর্ম দিয়ে সম্ভব নয়। প্রয়োজন জাতির জীবনে স্বকীয় ধারার নতুন রাজনীতি প্রবর্তন করা। তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন জাতির জীবনে একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণ সৃষ্টি করা। জাতীয়ভিত্তিক একটি কর্মসূচির ভিত্তিতে জাতিকে ভিতর থেকে জাগিয়ে তোলা। দেশের বিশিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রণীত আটাশ দফা; আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচির ভিত্তিতে আমরা ভৈরবে কাজ করে যাচ্ছি।
লেখক: সাবেক এমপি ও আহ্বায়ক জাগরণী শান্তিসংঘ, বাংলাদেশ
সম্পাদনা: আশিক রহমান