সংবাদমাধ্যমে মুসলিম মনীষীদের অবদান
মাহফুয আহমদ
প্রাচীনকালে মানুষের মাঝে খবরাখবর আদানপ্রদানের বিভিন্ন মাধ্যমের একটি ছিল কবিতা। কবিতা ছিল একটা শক্তিশালী মিডিয়া। লোকজন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ যেমন, মৃত্যু সংবাদ, বিজয়ের সংবাদ প্রভৃতি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে দিত কবিতার মাধ্যমে। আদিকালে বিশেষ সংবাদের জন্য নির্ধারিত কিছু চিহ্নও ব্যবহার করা হতো। যেমন, দিনে ধোঁয়া, রাত্রে আগুন জ্বালানো, রাস্তাঘাটে গন্তব্যপথ নির্ণয়ের জন্য রকমারি আলামত প্রসিদ্ধ ছিল। এরপর মানবসমাজে যখন লেখাপড়া ও শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপক প্রচলন হলো, তখন সংবাদ প্রচারে চিঠি লেখা ও প্রেরণ করা একটা প্রভাবশালী মাধ্যমে পরিণত হলো। সেই চিঠি আবার কখনও পাখি, কখনও মানুষ কিংবা ভিন্ন কোনো উপায়ে সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হতো। এভাবে হজরত ওমর রাযি.’র যুগে ডাকবিভাগের সূচনা হলো। সময়ের বিবর্তনে সর্বত্র নিত্যনতুন সংবাদমাধ্যম চালু হতে থাকল। ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে ছাপাখানার আবিষ্কার হলে এক্ষেত্রে আরো কার্যকরী সংবাদমাধ্যমের ধারা শুরু হতে থাকল। ধীরে ধীরে কাগুজে সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে অনলাইনের দ্রুততম মাধ্যমসমূহ অস্তিত্বে এলো এবং যেমনটা আমরা বলি, সারাবিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয় চলে আসে। আধুনিককালের আবিষ্কৃত সংবাদ সরবরাহের মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র আমাদের পরিচিত। যদিও এর আগে সংবাদ সরবরাহের রকমারি পদ্ধতি ছিল বলে আমরা জানি এবং মানি, কিন্তু এছাড়াও সংবাদপত্রেরও অস্তিত্ব ছিল বা এমন ধারনার অস্তিত্ব ছিল বলে আমাদের অনেকেরই জানা নেই। বিখ্যাত হাদিসবিদ এবং ইতিহাসবেত্তা আল্লামা সামআনি রাহ. (মৃ. ৫৬২ হি.) তাঁর ‘আল মুনতাখাব’ গ্রন্থে এমন দুর্লভ তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি নিজের শায়খ মুহাম্মাদ ইবনুল মুফাযযাল রাহ.’র জীবনালিপিতে লিখেন, তিনি সারাদিন নিজ অঞ্চলের খবরাখবর লেখায় ব্যস্ত থাকতেন।
পরে তা অন্যান্য দেশে পাঠাতেন। এতে জিনিসপত্রের মূল্য, ঘটনাদি এবং সামাজিকচিত্র তুলে ধরতেন। তাঁর খুব আগ্রহ ছিল এতে। কোনো তথ্যই তিনি না লিখে ছাড়তেন না। এমনকি তা বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী না হলেও। এগুলো তিনি স্বীয় বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত লোকদের নিকটও প্রেরণ করতেন। ফলে এ ক্ষেত্রে তিনি বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। (আল মুনতাখাব; সামআনি, ৩/১৬২৭, দারু আলামিল কুতুব, রিয়াদ, ১ম সংস্করণ ১৪১৭ হি./১৯৯৬ খ্রি.)
এই উদ্ধৃতি থেকে প্রতিভাত হচ্ছে যে, আজ থেকে এগারো শত শতাব্দী পূর্ব থেকে একজন মুসলিম মনীষী সংবাদ প্রচারে কত যতœবান ছিলেন। বলতে গেলে তিনি একাই একটা সংবাদপত্র চালু করেছিলেন। বস্তুত একজন মুসলিম হিসেবে দুনিয়ার সবজায়গার, বিশেষত মুসলমানদের সংবাদ ও খবরাখবর জেনে রাখা উচিত। বরং এটা আমাদের প্রিয় নবীজির শিক্ষা।
হিনদ বিন আবি হালা’র এক নাতিদীর্ঘ বর্ণনায় এসেছে, নবীজির দৈহিক গঠন ও চালচলন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এবং তিনি নিজ সঙ্গীদের খোঁজখবর নিতেন, সমাজে সংঘটিত বিষয়াদি সম্পর্কে লোকদের জিজ্ঞেস করতেন, এ প্রসঙ্গে ভালো বিষয়গুলোর প্রশংসা করতেন এবং মন্দ বিষয়গুলোর নিন্দা জানাতেন।” (শামাইলে তিরমিযি: ৩৩৬) হযরত আনাস রাযি. বর্ণনা করেন, ‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ছিলেন! তাঁর কোনো সঙ্গীকে তিনদিন না দেখলে তার সম্বন্ধে লোকদের জিজ্ঞেস করতেন। সফরে থাকলে তার জন্য দুআ করতেন। উপস্থিত থাকলে সাক্ষাত করতেন। আর অসুস্থ থাকলে দেখতে যেতেন।’ (কানযুল উম্মাল, ৪/৩০)
মুফতিয়ে আজম পাকিস্তান, মুফতি মুহাম্মাদ শফি রাহ. বলেন, এ দুটি বর্ণনা নববী আদর্শে খবর অনুসন্ধান এবং সাহাবিদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়ার গুরুত্ব প্রমাণ করছে। আজকাল তো মুসলিম উম্মাহর সার্বিক অবস্থা জানার অন্যতম মাধ্যম হলো মিডিয়া। অতএব: ১. মিডিয়া সুন্নাতে তাফাক্কুদ তথা মুসলমানদের খোঁজখবর নেওয়ার এ সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। ২. তা ছাড়া মুসলমানদের জাতীয় সমস্যা ও অসুবিধাগুলো এর মাধ্যমে সহজেই রাষ্ট্রযন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। ৩. এর দ্বারা মুসলমানদের অধিকার আদায়ের দাবি পেশ করা যায়। ৪. দ্বীন প্রচার ও প্রসারের কাজও এর মাধ্যমে উত্তমরূপে সম্পাদন করা যায়। (আদাবুল আখবার; জাওয়াহিরুল ফিকহ, ২/৪৬৭) লেখক: আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন