সড়ক দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার সক্ষমতা বাড়ছে বাংলাদেশের
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, আহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছে সরকার। সেই জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। নানামুখী পদক্ষেপ ও উদ্যোগের কারণে আগের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে, সেই সঙ্গে কমেছে মৃতের সংখ্যাও। ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ বছর চার মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৩০৯৮ জন। আর ২০০৯-২০১৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সাত বছর সাত মাসে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যু হয় ১৮৫১০ জনের। আগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে মারা যেতো ৮.৮৯ জন। এখন সেখানে মারা যাচ্ছে ৬.৭৮ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ২.১১ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
এছাড়া ওয়ার্ল্ড লাইফ এক্সপেক্টটেন্সীর হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে যেসব দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হয় এরমধ্যে ২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯০ এ। তখন এর হার ছিল গড়ে ১৬.৪। আর ২০১৪ সালের বিশ্ব অবস্থা বিবেচনা করে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘনার দিক থেকে অবস্থান ১০৯ নম্বরে। আর এর হার আগের চেয়ে কমে হয়েছে ১২.৮৭। ওয়ার্ল্ড লাইফ এক্সপেক্টটেন্সীর সাইটে রোববার ও বর্তমানেও একই হার রয়েছে। পুলিশের এফআইআর এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ বছর চার মাসে ৩৭২০ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৩৩০৯৮। গড়ে প্রতিদিন মারা গেছে ৮.৮৯ জন। গুরুতর আহত হয় ২৪০৭৫ জন। গড়ে প্রতিদিন ৬.৪৭, সাধারণ আহত হয় ৬১৯৭ জন। গড়ে প্রতিদিন আহত ১.৬৬ জন। এছাড়া মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১৭৯১টি। প্রতিদিন গড়ে ১১.২৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। মোট হতাহত হয়েছে ৬৩৩৭০ জন।
যেখানে ২০০১ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৪০৯১টি গড়ে ১১.২০ মৃতের সংখ্যা ৩১০৯ গড়ে ৮.৫১, গুরুতর আহত ২৪৪৯ জন, আহত ৭২৩ জন, গড়ে ৮.৬৯ জন। মোট হতাহত ৬২৮১ জন। ২০১১ সালে এসে তা কিছুটা কমে। সেখানে চারমাসের একটি হিসাবে দেখা যায়, ওই সময়ে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮৬৩টি, গড়ে প্রতিদিন ২.৩৬টি, মৃত্যের সংখ্যা ৮৩৬, গড়ে প্রতিদিন ২.২৯ জন, গুরুতর আহত ৪৬৫ জন, সাধারণ আহত ৮৫ জন। গড়ে প্রতিদিন ১.৫০। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৩৮৬ জন চারমাসে মারা যান ও আহত হন।
এছাড়া অন্য একটি হিসাবে দেখা যায়, ২০০৯-২০১৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সাত বছর সাত মাসে ২৭৩০ দিনে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যু হয় ১৮৫১০ জনের। গড়ে প্রতিদিন দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৬.৭৮ জন। আহত হয়েছে ১৪৪৪২ জন। গড়ে প্রতিদিন আহত ৫.২৯ জন। মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৪৫০টি। এরমধ্যে গড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭.১২টি।
এই চিত্র পর্যালোচনা করে সরকারের তরফ থেকে ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করার জন্য ২ আগস্ট ২০১০ সাল থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিচার ও শাস্তির বিধান আগের বিদ্যমান আইনে যথেষ্ট ছিল না। এই ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। সেই জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কেইস প্রকল্পের আওতায় ডিটিসিবি কর্তৃক মোটর ভ্যাহিকেল অর্ডিনেন্স ১৯৮৩ যুগোপযোগী করে রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রাফিক অ্যাক্ট নামে নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে ও আইন করে। সেখানে নতুন আইনে শাস্তির বিধি বিধানও সংশোধন করা হয়।
গাড়ি চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানের উপর সরকার গুরুত্বারোপ করার উদ্যোগ নেন। সেই হিসাবে ২০০৯-২০১০ সাল পর্যন্ত ৮২৫০ জন, ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে ১৮ হাজার পেশাজীবী গাড়িচালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ২০১১-২০১২ অর্থবছরে প্রায় ৩০ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়াও সারাদেশে বিভিন্ন সমাবেশ ও সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে।
সরকারি গাড়ি চালকদের জন্য অর্ধবার্ষিক বা বার্ষিক ভিত্তি তৈরি করে ফ্রেশার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই হিসাবে বিআরটিএ পরিবহন পুলের সরকারি গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বিআরটিএ এর সহায়তায় সরকারি পরিবহন পুলকর্তৃক ৯৮০ জন সরকারি গাড়ি চালককে রিফ্রেশার প্রদান করা হয়। চলমান অর্থবছরেও এই প্রশিক্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সিটবেল্ট ও হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা ও গাড়ি চালকদের মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ করা গেলে দুর্ঘটনা কমবে। সেই জন্য তা বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয় সরকার থেকে। সেই হিসাবে বিভিন্ন দৈনিকে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হচ্ছে। গাড়ি চালনাকালে মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ করে মোটরযান বিধিমালা ১৯৪০ সংশোধন করা হয়। এছাড়াও পুলিশের বিশেষ অভিযানে ও মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
ত্রুটিপূর্ণ রোড ডিজাইন সংশোধন, মিডিয়ান-ডিভাইডার তৈরি ও রোড সাইন স্থান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বুয়েটের এ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট ২০৯টি দুর্ঘটনা প্রবণস্থান চিহ্নিত করে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর রোড সেফটি সেল গঠন করে ত্রুটিপূর্ণ রোড ডিজাইন সংশোধন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। প্রয়োজনীয় রোড সাইন স্থাপনের কাজও চলছে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ বিভিন্ন মহাসড়কে ডিভাইডার-মিডিয়ান তৈরিসহ চারলেনে উন্নীত করার কাজ চলছে।
বিআরটিএ এর জনবল বৃদ্ধি করে ও শূন্যপদ পূরণ করে দক্ষ ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই হিসাবে বিআরটিএ অনুমোদিত জনবল ৫৭৩টি । শূন্যপদ ২১২টি। বর্তমান সরকারের আমলে নিয়োগ করা হয়েছে ৮১টি পদে। আর নিয়োগের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ৩৮টি পদ। এছাড়া আরও ৩৫০টি পদ তৈরির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপনের কার্যক্রমও হাতে নেওয়া হয়েছে। এই সব পদক্ষেপের পাশাপাশি যোগাযোগমন্ত্রীও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। যা সড়ক দুর্ঘটনারোধে কাজ করছে। সম্পাদনা: রফিক আহমেদ