একাত্তরের ২৫ মার্চ ও মুক্তিযুদ্ধ
ডা. এম এ হাসান
১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে পুরাতন ঢাকার নওয়াবপুর এলাকায় মোতায়েন করা হয়। শেরে বাংলা নগরসহ পার্শ্ববর্তী মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় বসবাসরত বিহারিদের রক্ষা করার জন্য ফিল্ড রেজিমেন্টকে মোতায়েন করা হয়। এ ছাড়া ১৮ পাঞ্জাবের এক কোম্পানি, ২২ বেলুচের এক কোম্পানি ও ৩২ পাঞ্জাবের এক কোম্পানি সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বিশেষ করে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল আক্রমণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মেজর জেড এ খানের নেতৃত্বধীন এক কোম্পানি কমান্ডোকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাড়ি আক্রমণ করে তাকে আটক করার আদেশ দেওয়া হয়। এক স্কোয়াড্রন এম-২৪ ট্যাংক ২৬ মার্চ রাতে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়।
প্রাথমিক প্রতিরোধ: ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরমুখী যাত্রা করা মেকানিক্যাল কলামটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ঢাকার ফার্মগেটে। এখানে বড় বড় গাছের গুড়ি, অকেজো স্টীম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তুপ জমিয়ে রাখা হয়েছিল পথটি আটকাবার জন্য। সেইসঙ্গে জঙ্গি জনতার প্রতিরোধ অপেক্ষমান ছিল। জনতার মাঝ থেকে অনেকে ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিচ্ছিল এবং কেউ কেউ বন্দুকও ছুঁড়ছিল। এই প্রতিরোধ ১৫-২০ মিনিট স্থায়ী হয়। এ ছাড়া প্রতিরোধ ছিল হলিক্রস কলেজের কাছে এবং কারওয়ান বাজারের রেল লাইনের কাছে। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে ফার্মগেট প্রতিরোধ ভেঙে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কগুলো সামনে এগিয়ে যায়। এই ট্যাঙ্কগুলো সরাসরি ইউনিভার্সিটি, পিলখানা ও রাজারবাগ, মতিঝিল এলাকায় গেলেও রাতের শেষপ্রহর পর্যন্ত এগুলো তেজগাঁও এলাকায় প্রবেশ করেনি। তাই সেখানকার ব্যারিকেড সকাল পর্যন্ত থেকে যায়। ২২ বেলুচ আগে থেকেই পিলখানায় অবস্থান করায় ইপিআর-এর প্রতিরোধ তেমন শক্তিশালী অবস্থায় ছিল না। এরপরও ওই পিলখানা থেকে ওয়্যারলেসে সারাদেশে প্রতিরোধের নির্দেশ পাঠানো হয় ২৫ মার্চ রাতে।
ঢাকা পিলখানায় প্রায় ২৫০০ জন ইপিআর (বর্তমানে বিডিআর) সদস্য অবস্থান করেছিল। এদের মধ্যে ২৫০ জন নিরাপত্তা বিভাগ, ৪৫০ জন সদর দফতর উইং এবং ২০০ জন সদর দফতরে কর্মরত ছিল। ঢাকা সেক্টরে তিনটি উইং যথাক্রমে ১৩, ১৫ এবং ১৬ উইং অবস্থিত ছিল। প্রত্যেক উইং-এ ৪৫০ জন্য সৈন্য কর্মরত ছিল। (বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭১৫-১৯৭১; সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৬২৩) চারজন বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন দেলওয়ার, ক্যাপ্টেন দানিয়াল ইসলাম, ক্যাপ্টেন লতিফ ও ক্যাপ্টেন আজাদ ইপিআর-এ চাকরিরত ছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ২২ বেলুচ রেজিমেন্টকে পিলখানায় মোতায়েন করা হয়। বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পিলখানাস্থ ইপিআর-এর অফিসার ও সৈন্যদের মনে গভীর রেখাপাত করে। পিলখানা ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় তাদের মাঝে বেসামরিক জনগণের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে তারা বাংলাদেশের নতুন জাতীয় পতাকা পিলখানার একটি গাছের মাথায় উত্তোলন করে। এটা ছিল ইপিআর সৈন্যদের দেশপ্রেম, আবেগ ও সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ।
পাকিস্তানি সৈন্যরা ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর আক্রমণ করে। সেখানে প্রায় ১০০০ বাঙালি পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই বীরত্বমূলক প্রতিরোধযুদ্ধে কয়েকশত পুলিশ শহীদ হন রাত আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে। এদের সঙ্গে যে সাধারণ মানুষ যোগ দিয়েছিল এই অসম যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে তখনই। থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে যে যুদ্ধ তারা শুরু করেছিল তা সবার জন্য প্রেরণা হয়ে থাকে। যারা শহীদ হন তাদেরকে ধলপুর ও বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলা হয়। জীবিতদের একটি বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকা সেনাবিনাস থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বেরিয়ে পড়ার পরপরই পিলখানা আক্রমণ করে এবং নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পিলখানায় অবস্থিত বাঙালি সৈন্যরা সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেই প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। বাঙালি সৈন্য ও দখলদার বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হয় এবং সারারাত অব্যাহত থাকে। শতশত বাঙালি সৈন্য নিহত হয়। একজন পাকিস্তানি অফিসারসহ বহু পাকিস্তানি সৈন্যও নিহত হয়। যুদ্ধ এতটা প্রচ- ছিল যে ২৬ মার্চ অপরাহ্নে ট্যাংক বাহিনীকে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্যার্থে পিলখানায় আসতে হয়। সুতীব্র একটা যুদ্ধ হয় পিলখানা ৩য় গেটের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বেই ইপিআরগণ অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে অসম যুদ্ধে টিকতে না পেরে তারা বুড়িগঙ্গা অতিক্রম করে জিঞ্জিরায় অবস্থান গ্রহণ করে। ইপিআরদের একটি অংশ বাস নিয়ে চলে যায় মিরপুরের দিকে। সেখানে তারা পাকিস্তানি ও অবাঙালিদের মোকাবিলা করে এবং হরিরামপুর ও সাভার হয়ে আরিচার দিকে সরে যায়। (চলবে-২)
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী
সম্পাদনা: আশিক রহমান