মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল
২২ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে ঢাকায় সুলতানা কামালের জন্ম। সুলতানা কামালের মা দেশবরেণ্য নারীনেত্রী প্রয়াত কবি বেগম সুফিয়া কামাল, বাবা মরহুম কামাল উদ্দীন আহমদ খান। হিসাবরক্ষক পেশায় থাকলেও সুলতানার বাবা ছিলেন একজন সাহিত্যিক। বাবা-মায়ের তিন ছেলে তিন মেয়ের মাঝে সুলতানা পঞ্চম। এই পরিবারের সদস্যরা দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সকল আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক অন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, নারীমুক্তি আন্দোলন প্রভৃতিতে এ পরিবারের সংশিশ্লষ্টতা ছিল সর্বাত্মক। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নেতৃত্বও দিয়েছেন প্রজ্ঞার সঙ্গে।
মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কমাল তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন লীলা নাগ প্রতিষ্ঠিত নারীশিক্ষা মন্দির থেকে। পরে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৬৫ সালে। হলিক্রস কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি এইচএসসি উত্তীর্ণ করেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে ১৯৭০-এ বিএ ও ১৯৭১-এ এমএম ডিগ্রি লাভ করেন।
ছোটকাল থেকেই তিনি তার মাকে নিরলস সাহিত্যচর্চা করতে দেখেছেন। সাহিত্যচর্চা তখনকার যুগে খুব কম মেয়েই করত। তমসাচ্ছন্ন যুগে তার মায়ের সাহিত্যচর্চা ছিল সমাজের প্রতি কটাক্ষ। প্রথমে বেগম সুফিয়া কামাল সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজসেবা শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি ঝুঁকে পড়েন সমাজসেবায়।
১৯৭৮ সালে সুলতানা কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। আর হল্যান্ড থেকে ১৯৮১ সালে পান মাস্টার্স ইন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এমডিএস) ডিগ্রি। ১৯৮২ সালে তিনি বিয়ে করেন আইনজীবী সুপ্রিয় চক্রবর্তীকে। পরিবারে রয়েছে তাদের একমাত্র কন্যা সুদো অমৃতা দিয়া। বর্তমানে সুলতানা কামাল একজন আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কর্মরত। তিনি আইন সালিশ কেন্দ্র, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ফ্রিডম ফাউন্ডেশন, উইমেট লিভিং আন্ডার সুমলিম ল’স, সম্মিলিত নারী সমাজ ও অন্যান্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
শৈশবে তিনি কচিকাঁচার মেলার সদস্য হন এবং একসময়ে এই সংগঠনের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ছায়ানটেরও তিনি সক্রিয় কর্মী ছিলেন। শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এখানে তার পরিবারের প্রভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
২৫ মার্চ রাতে বড় ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম বেতার থেকে ফোন করে জানান দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুলতানা কামাল সক্রিয় ছিলেন। প্রথমে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ, তথ্য সরবরাহ, সীমান্ত পারাপারে সহযোগিতা প্রভৃতি কাজে যুক্ত ছিলেন।
ঢাকায় তারা নিবাস ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে। এই বাড়িতে এয়ারফোর্সের অফিসার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার) হামিদুলাহও তার পরিবার নিয়ে থাকতেন। ১৯৭১-এর জুন মাসের প্রথমদিকে হামিদুলাহকে পাক-সামরিকজান্তা ডেকে পাঠালে তিনি সুলতানাদের বাসায় আসেন পরামর্শ নিতে। এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে হামিদুলাহকে সীমান্ত পার করতে সাহায্য করা হয়। এই ঘটনার পর তাদের বাড়ির কাজের ছেলেকে পাক আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়। সবাই শঙ্কিত হয়ে পড়েন যে কাজের ছেলের কাছ থেকে তাদের দলের সকলের নাম ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এই দলে ছিলেন ফতেহ আলি, আলভী, আশফাক সামাদ, রুমী, আজাদ, শাহাদাত চৌধুরী, জাকিয়া খাতুন, শিরীন প্রমুখ। তখন সকলে সিদ্ধান্ত নেন যে দেশের অভ্যন্তরে আর অবস্থান না করে সীমান্ত পার হয়ে ওপারে গিয়ে কাজ করার।
রবীন্দ্রনাথ বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সক্রিয় থেকে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি সংস্কৃতি সংসদের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন এ সময় সামরিকজান্তার সঙ্গে মুখোমুখি তর্ক করে সংস্কৃতি সংসদের অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি আদায় ও তা সম্পাদন করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পিলখানায় রাইফেলস্-এর সদস্যদের সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষ ও রাজারবাগে পুলিশদের প্রতিরোধের কথা জানতে পারেন।
জুনের ১৫ তারিখ নিজেদের বাড়ি ছেড়ে সুলতানা কামাল তাদের পরিবারের সঙ্গে আশ্রয় নেন ধানমন্ডি ২৬ নম্বর সড়কের মিসেস আতিয়া হকের বাড়িতে। ১৬ তারিখে বেশ বড় একটা দলসহ তারা কুমিলার পথে রওয়ানা হন সীমান্ত পার হবার জন্য। দলে ছিলেন হামিদুলাহ সাহেবের স্ত্রী, তিন ছেলে, নাসরিন আহমেদ, মিলিয়া গনি, শাহাদাত চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান বেনু, সুলতানা কামাল ও তার বোন সাঈদ কামাল। রেনু যদিও আগেই সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন তবুও দেশে আসতেন অন্যদের সাহায্য করবার জন্য।
ভারতে পাড়ি দেবার পর জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আগরতলায় সোনামুড়ি, দারোগা বাগিচা ও বিশ্রামগঞ্জে অবস্থান করেন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি স্বেচ্ছাসেবী নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। কোনো প্রশিক্ষণ নেননি, তবে কাজ শিখেছেন তদানীন্তন ক্যাপ্টেন (ডাক্তার) আখতারের সঙ্গে কাজ করতে করতে। সুলতানা কামাল পরে বাংলাদেশ হাসপাতালের সার্জিক্যাল ইউনিটের চার্জে ছিলেন। ছোট বোন সাঈদ কামাল ছিলেন মেডিকেল ইউনিটের দায়িত্বে। তাদের সঙ্গে পরে এসে যোগ দেন খুকু আহমদ ডালিয়া সালাউদ্দিন, সবিতা মন্ডল, পদ্মা রহমান, নীলিমা আহমদ, মিনু বিলাহ, আসমা আলম, রেশমা আলম, জাকিয়া খাতুন। অক্টোবরের দিকে ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম যোগ দেন তাদের সঙ্গে।
সুলতানা কামাল ছোটবেলা থেকেই ছিলেন গঠনমূলক ও সংস্কৃতিসেবী তিনি যখন কচিকাঁচার সদস্য ছিলেন তখন থেকেই এদেশের দাদাভাই নামে খ্যাত শ্রদ্ধেয় রোকনুজ্জামান খানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। কচিকাঁচা বাংলাদেশের অতি প্রাচীন ও রাজনীতি বিবর্জিত সংগঠন। এখানে যারাই সদস্য হয়েছেন তারাই স্বার্থকভাবে সমাজ, সংস্কৃতি, দেশাত্মবোধ ধারণা পেয়েছেন। এসব স্পর্শকাতর বিষয়গুলো তার মধ্যে ছিল সমানভাবে বর্তমান। এমনিতে প্রবাদ আছে কচিকাঁচার মেলার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানে কোনো রাজাকার তৈরি করা হয়নি।
সুলতান কামাল একজন আইনজীবী হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি এসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকা মহিলাদের আইনগত সাহায্য প্রদান করেন। তিনি স্কুল পর্যায় থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত প্রচ-ভাবে আন্দোলন করেন। তিনি ১৯৭১ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। এছাড়া বড় বড় আন্দোলন সংগ্রামে তিনি বাবা-মার আদর্শ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালিয়ে যান।
সুলতানা কামাল দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হন এবং স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের নয়টি মাস নিরলসভাবে কাজ করেছেন। অস্ত্র প্রশিক্ষণ, নার্সের প্রশিক্ষণ, শক্রর মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ নেন। তিনি যেমন নিষ্ঠাবান তেমনি শিক্ষায় উন্নত।
সুলতানা কামালের নেতৃত্ব সবাই খুবই পছন্দ করেন। তাই তিনি যখনি ডেকেছেন তখনি সবাই তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় যে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন তা বর্ণনাতীত। আহত সৈন্যদের সেবা করা, তাদের ঔষধপত্র, খাবার সরবরাহ করা ইত্যাদি ছিল তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব তিনি ড. সেতারা বেগম বীর প্রতীকের সঙ্গে অস্থায়ীভাবে গঠিত হাসপাতালে কাজ করেন। তার সঙ্গে ছিলেন আরও অনেক মেয়ে। তারা পুরুষের পাশাপাশি থাকতেন এবং স্বাধীনতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করেছেন। বর্তমানে বিভিন্ন মানবসেবী সংগঠনের সঙ্গে তিনি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। মায়ের মতোই মানবসেবার আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে চলেছেন তিনি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
সম্পাদনা: আশিক রহমান