চিকিৎসক নারীদের মাতৃত্বকালীন অধিকার নিশ্চিতে বাধা কোথায়?
ডা. জাকির হোসেন
সরকারি অন্যান্য সেক্টরে যেভাবে কাজের পরিবেশ গড়ে উঠেছে ঠিক সেভাবে স্বাস্থ্যখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেইভাবে স্থাপনা গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সকল সরকারি হাসপাতালে যে কয়েকটি হাতে গোনা আবাসিক স্থাপনা রয়েছে সেগুলোর প্রায় সবকটির অবস্থাই জরাজীর্ণ। বহু সরকারি হাসপাতালের এইসকল আবাসিক স্থাপনায় স্থানীয় নেশাখোরদের আখড়ায় পরিণত হয়। সেখানে পুরুষ চিকিৎসকেরাই নিরাপত্তার অভাবে থাকতে চান না। এই কঠিন বাস্তবতায় নারী চিকিৎসকদের প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে এসে অফিস করা একবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। গর্ভকালীন সময়ের সঙ্গে তাদের ভোগান্তির মাত্রা আরও বহুগুনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার এই সংকটকালীন দুর্বলতার সুযোগ নিতে থাকে অফিসের প্রায় সকল কর্মচারী, এমনকি কিছু চিকিৎসকও। বিশেষ করে যে সকল চিকিৎসক প্রশাসনিক পদে কর্মরত। এই অভিযোগ বেশি পাওয়া যায় কিছু সংখ্যক উপজেলা পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং কিছু সংখ্যক সিভিল সার্জনের বিরুদ্ধে। তারা এই সুযোগটি গ্রহণ করেন। বিশেষ করে যখন নারী চিকিৎসকেরা মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য কাগজপত্র অফিসে জমা দেন। প্রায় সকল হাসপাতালের অফিস সহকারী, প্রধান কর্মকর্তা মোটা অংকের টাকা না দিলে তাদের ছুটির কাগজপত্র অগ্রায়ন করতে টালবাহানা শুরু করেন। নারী চিকিৎসকেরা তাদের শারীরিক সংকটের জন্য ঝামেলা পোহাতে চান না। বাধ্য হয়েই ঘুষ দিতে হয় তার মাতৃত্বকালীন অধিকার পাওয়ার জন্য।
ভোগান্তির মাত্রা চরমে পৌঁছে নারী চিকিৎসকের বাচ্চা প্রসবের পর। প্রসবকালীন সময় এবং বাচ্চা প্রসবের পর তার ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ করে যখন কাজে যোগদান করে হাসপাতালগুলো আবাসনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় শিশু বাচ্চাকে বাসায় অন্য কারও কাছে রেখে তার হাসপাতালে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। হাসপাতালগুলোতে রোস্টার অনুযায়ী সকল চিকিৎসককে বৈকালিক এবং রাতের শিফটে ডিউটি করতে হয়। সেই সময় নারী চিকিৎসকেরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে যান। রাতের বেলায় বুকের দুগ্ধ পানরত বাচ্চাকে বাসায় রেখে হাসাপাতালে কাজ করা একজন মায়ের জন্য কত কষ্টকর তা ওই মা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এই রকম বেশকিছু অভিজ্ঞতার সাক্ষী আমি নিজে। নিজ চোখে দেখেছি বুকের দুধের জন্য বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে গেছে অথচ এই নিষ্পাপ শিশুর মা তার মাতৃত্বকে মাটি চাপা দিয়ে এক বুক কষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ডিউটিরত। দিনের বেলা কোনো মা যে তার বুকের শিশুকে হাসাপাতালে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তার চাকরি করবে সেই রকম কর্ম পরিবেশ আজও কোনো হাসপাতাল ঘিরেই তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি সরকারি হাসপাতাল হলোÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকের বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল। এখানেও অনেক ডিপার্টমেন্ট আছে যেখানে চিকিৎসকদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো স্যানিটেশন নেই আর নারী চিকিৎসকদের দুগ্ধপান করার জন্য বাচ্চাদের বেস্ট ফেডিং উইং তো এখনো বহু দূর। এই উদাহরণ থেকে সারা বাংলাদেশের সব সরকারি হাসাপাতালের কর্ম পরিবেশ সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায়। সাধারণত শিশুকালে বাচ্চারা একটু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে সেই সময়ে একটি শিশুর জন্য চিকিৎসার চেযে বড় প্রয়োজন মায়ের সেবা।
কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতালে কাজের চাপ এত বেশি যে কারণে কোনো নারী চিকিৎসকের বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়লে তার কাজ কেউই ভাগাভাগি করে নিতে চান না। ফলে অসুস্থ বাচ্চাকে বাসায় রেখেই বেশিরভাগ সময় হাসাপাতালে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে হয়। এই রকম বহু প্রতিবন্ধকতাকে পাড়ি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের নারী চিকিৎসকদের। এই সকল প্রতিবন্ধকতার সবটুকু চিত্র মিডিয়ায় তুলে ধরার মতো ভাষাও নেই। বাংলাদেশ বহু বছর নারী নেতৃত্বের অধীনে আছে। এই সুযোগে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের মাতৃত্বের অধিকার অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নারী ও শিশু অধিকারের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। কিন্তু বহু দিন ধরে স্বাস্থ্যখাতের সমস্যাগুলো যেমন তার নজরে আনার মতো দক্ষ নেতৃত্বের অভাব ছিল সেই সঙ্গে নারী চিকিৎসকদের নারী ও মাতৃত্বের অধিকারের বিষয়টিও তার নজরে দেওয়ার মতো কোনো নারীবাদীকে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তাদের এই মাতৃত্বের অধিকার ফিরিয়ে দিতে না পারলে, আপাতদৃষ্টিতে নারীরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে মনে হলেও একসময় তারা যে শিশুদের এই দেশে ভবিষ্যৎ হিসেবে রেখে যাবে সে প্রজন্ম হবে মানবিক মূল্যবোধহীন অন্ধকার প্রজন্ম। তাই সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও চেতনা নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এটাই সচেতন চিকিৎসক মহলের প্রত্যাশা।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান