সাংস্কৃতিক চেতনায় অপশক্তি মোকাবিলা
হাশেম খান
আমরা কিন্তু সংস্কৃতি উদ্যাপন করি না। আমরা বাংলা নববর্ষকে উদ্যাপন করি বা পহেলা বৈশাখকে উদ্যাপন করি। এটা আমাদের সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংস্কৃতি কিন্তু কেউ পালন করে না। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান আমাদের জীবনযাপন সব মিলিয়েই কিন্তু সংস্কৃতি। সুতরাং আমরা সংস্কৃতিবান জাতি হলে আমাদের নিজস্ব যে ভাষা, যে আচার-অনুষ্ঠানগুলো রয়েছে, আমাদের ধর্ম আছে, সব মিলিয়েই কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি। সেদিক থেকে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ উদ্যাপন একটা স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এটা একেক সময় একেক রকম হয়ে আসছে। কারণ অর্থনীতির সঙ্গে এবং সময়ের সঙ্গে, দেশের রাজনীতির সঙ্গে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। আজ থেকে ৫০ বছর আগে এই পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ যেভাবে পালিত হতো, এখনকার প্রেক্ষাপট অন্যরকম। তখন ছয় ঋতুভিত্তিক চাষবাস হতো। আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি কৃষক। তারা বাংলা নববর্ষকে অন্যরকমভাবে পালন করতেন। এবং আমরাও করতাম। কারণ আমরাও কৃষখদেরই সন্তান। যদিও আমরা শহরে বাস করি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৫ বছর। তারপরেও আমাদের প্রধান অর্থনৈতিক বুনিয়াদ হচ্ছে কৃষি। সেদিক থেকে আমি মনে করি যে, বাংলা নববর্ষ এখনো পর্যন্ত বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় সবচাইতে উল্লেখযোগ্য একটি দিন বা একটি ঘটনা বা একটি সময়। এজন্য এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানÑ যে বাঙালি, যে বাংলা ভাষায় কথা বলে, যে বাংলাদেশে বাস করে, সেই কিন্তু পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষটি ঘটা করে আনন্দের সঙ্গে উদ্যাপন করে। অন্তত তার পুরনো এক বছরের হিসেব-নিকেশটা করে নেয় এবং সামনের এক বছর সে কিভাবে সময়টাকে তার অর্থনীতিতে একটা সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে সব কিছুই পরিকল্পনা করে নেয়। সে জন্য হালখাতার বিষয়টা এখন কিছুটা ম্লান হলেও এখনো আছে। হালখাতা হচ্ছে বছরের শেষে হিসাব-নিকাশ করা হয়। এটা এখনো কিন্তু গ্রামে হয়। এখনো দোকানে দোকানে বাজারে বাজারে করা হয়। ঢাকা শহরেও কিন্তু হচ্ছে। এবার অনেকগুলো হালখাতার আমন্ত্রণ পেয়েছি আমি পহেলা বৈশাখের বা নববর্ষের দিনে।
গ্রামের মানুষ একরকমভাবে বৈশাখ পালন করে, শহরের মানুষ একধরনের করে, আবার আমাদের আদিবাসীরা এক ধরনের করে। প্রত্যেকেই কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে এই দিনটি উদ্যাপন করে। ঢাকা শহরে চারুকলা থেকে আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রা করি। কিন্তু একসময় মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না, মিছিল ছিল না। এটা প্রথম হয়েছিল ১৯৭০ সালে চারুকলাতে, কালবৈশাখী একটা প্রদর্শনী করেছিলাম। তার আগে আগেই আমরা করলাম বায়ান্ন উৎসব। এই যে গ্রামের সংস্কৃতির সঙ্গে শহরের সংস্কৃতির যে একটা মেলবন্ধন এবং উদ্যাপনের যে পরিবর্তন নিয়ে আশা এবং সেটা হচ্ছে স্বাভাবিক পরিবর্তন, সহজ প্রকাশ। সেদিক থেকে আমি মনে করি এই পরিবর্তন এসেছে। গ্রামে আগে মেলা হতো। এখনকার মেলার বিষয়বস্তু, মেলায় যেসব জিনিসপত্র ওঠে, মেলায় যেসব খেলাধুলা হয়, যাত্রা থেকে শুরু করে পুতুল নাচ সেগুলোরও কিন্তু পরিবর্তন এসেছে। আসাটাও খুব স্বাভাবিক। এই পরিবর্তন আসা কোনো দোষণীয় নয়। কারণ সময়ের সঙ্গে, অর্থনীতির সঙ্গে, রাজনীতির সঙ্গে, এগুলো পাল্টাবে।
গত বছর আমাদের এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর অনুমোদন পেয়েছে, স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্বব্যাপী। এটি বাংলা নববর্ষের সূচনায়, শুভ চিন্তায়, শুভ কামনায়, আমরা এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে থাকি। সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি। এটা কিন্তু বিরাট একটা অর্জন। বাংলাদেশের মানুষের এই নববর্ষ পালনের। সমস্ত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়াতে চাই। আজকে যে জঙ্গিবাদের প্রকাশ হচ্ছে, আজকে যে মৌলবাদ প্রকাশ ঘটিয়েছে শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে তারা শান্তি বিনষ্ট করছে।
ছায়ানটের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। গানের মাধ্যমে এই নববর্ষ পালন শুরু করেছিল আজ থেকে ৫০ বছর আগে। এটা কম কথা নয়। এটা বিরাট অর্জন। সব প্রতিষ্ঠানেই কিন্তু যার যার স্থান থেকে নাটক হয়, ড্রামা হয়। তারপরে আমরা প্রত্যেকে নতুন পোশাক-আশাক পড়ি। একসময় আমরা ঈদ এবং পূজায় পড়তাম। খ্রিস্টানরা বড় দিনে পড়ত। তারপরে বৌদ্ধরা বৌদ্ধপূর্ণিমাতে পড়ত। এখন ধর্মভিত্তিক পালন হয়, জীবনভিত্তিকও পালিত হয়। বাংলা নববর্ষে আমরা সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসে অনুষ্ঠান করছি, খাচ্ছি, ঘুরছি-ফিরছি, মেলা দেখছি, ছায়ানটে যাচ্ছি, গান শুনছি, তারপরে আবার চারুকলার অনুষ্ঠানে আসছি, শিল্পকলার অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। এই যে বাঙালির বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি বিভিন্ন সময় আমাদের রাজনৈতিক নেতারা, আমাদের সংস্কৃতিবান নেতারা তা তুলে ধরার জন্য অনেকে জীবন দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তার জীবন দিয়েছেন। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। ২ লাখ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছেন। আমাদের শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চার জন্য। এটা কিন্তু সাংঘাতি ব্যাপার।
আমাদের কতগুলো অনুষ্ঠান আছে। যেমনÑ ঈদ, নববর্ষ, পূজায় যখন বিভিন্ন মানুষজনের সঙ্গে দেখা হয়, অনেকসময় যার সঙ্গে বৈরিতা আছে তিনিও কোলাকুলি করেন। তিনিও আমাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান। এর মধ্যে দিয়ে আমরা কিন্তু অনেক ভেদাভেদ ভুলে যাচ্ছি। মানসিক পরিবর্তন তো হচ্ছেই। ভালো কি? সুন্দর কি? খারাপ কি? এই যে নতুন পোশাকে ছেলে-মেয়েরা থেকে শুরু করে বৌ সবাই যে নতুন কাপড় পড়ছে, তাতে সে একটা ভালো জিনিস বেছে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভালো চিন্তা করার চেষ্টা করছে। ভালো কিছু খাওয়ার চেষ্টা করছে এবং সুন্দরভাবে দিনটা কাটানোর মধ্যদিয়ে সুন্দরের প্রতি তার যে একটা মানসিক পরিবর্তন, মানসিক বোধের মধ্যে যে একটা জাগরণ আসছে এটা তো ইতিবাচক। মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদরা কিছুতেই বিস্তার লাভ করতে পারবে না। বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলভাবে সবকিছুতে সংস্কৃতি দিয়েই কিন্তু মোকাবিলা করছে। দেশের আইন তো আছে। সংস্কৃতি কিন্তু মানসিক চেতনায় একটা ঝড় তুলছে, একটা আলোড়ন তুলছে। সেটা তো অবশ্যই ইতিবাচক।
পরিচিতি: চিত্রশিল্পী
মতামত গ্রহণ: তানভীন ফাহাদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান