বৈশাখকেন্দ্রিক কেনাকাটায় চাঙ্গা হয়ে উঠেছে অর্থনীতি
জাফর আহমদ: বৈশাখকেন্দ্রিক বেচা-কেনায় চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ক্ষুদ্র শিল্প খাত। দর্জির দোকান থেকে শুরু করে মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরির কুমার বাড়ি সরগরম। বৈশাখী মেলা সকল ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর অনুষ্ঠান হওয়ায় আবহমান কাল ধরে দেশীয় পণ্য বিক্রির প্রধান উপলক্ষে পরিণত হয়েছে। বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনিসেফ সম্প্রতি কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করায় দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও কেনা-কাটার প্রধান দিনে পরিণত হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, এবারের পহেলা বৈশাখ কেন্দ্রিক যে কর্মযজ্ঞ হয়েছে তার অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এসব পণ্যের পুরোটাই দেশীয় পণ্য। কাপড়-চোপড়, গয়না, খেলনা, মাটির পণ্য, মিষ্টিসহ বিভিন্ন দেশজ পণ্য কেনা বেচা হয়। এসব পণ্য পুরো দেশজ ও ক্ষুদ্র শিল্পজাত হওয়ার কারণে পহেলা বৈশাখের কয়েক মাস আগে থেকেই তৈরি দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র শুরু হয়েছে নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মকা-। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায় পহেলা বৈশাখে অর্থনীতির গতি বেড়েছে। এ ব্যাপারে শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ বলেন, বাঙালি আবহমান কাল ধরে পহেলা বৈশাখকে সার্বজনীন উৎসব হিসেবে পালন করে আসছে। কিন্তু গত কয়েক বছর পহেলা বৈশাখে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখও ঈদের মতোই হয়ে গেছে। ঈদের আগে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হয়, পহেলা বৈশাখেও ব্যবসা-বাণিজ্যে একই অবস্থা বিরাজ করছে। মানুষ পহেলা বৈশাখে এখন ঈদের মতো খরচ করে। ঈদের মতো নতুন নতুন পোশাক কিনে। নানা রকমের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাণিজ্য হয়।
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে সব চেয়ে বেশি সাড়া পড়ে কাপড়ের বিপনীগুলোতে। রাজধানী ঢাকা শহর থেকে শুরু করে জেলা শহর শহর পর্যন্ত কেনা-কাটার ধুম পড়ে যায়। ফ্যাশন হাউসগুলো বৈশাখী মেলাকে সামনে রেখে বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড় বাজারে ছাড়ার কারণে
মেলার কেনাকাটায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। পহেলা বৈশাখে বাজারে আসা নতুন পোশাকের বাহারি ডিজাইন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। রাজধানীসহ আশপাশের পোশাক তৈরির ছোট্ট ছোট্ট কারখানাগুলোতে রাত-দিন কাজ করেছে কারিগররা। এখনো তার রেশ রয়ে গেছে। গত বছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বোনাস ঘোষণা করা হয়। পর্যায়ক্রমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝেও বোনাস দেওয়া শুরু হয়েছে। বৈশাখী বোনাস কেনা-কাটায় উৎসবের ইমেজ এনে দিয়েছে।
মহানগর ব্যবসায়ী নেতা ও এফবিসিসিআই এর পরিচালক হেলাল উদ্দিন আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র আমাদের দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা বেড়ে যায়। আমরা দেশীয় পণ্য ব্যবহার করছি, দেশীয় পণ্য তৈরি করছি, দেশীয় পণ্য বেচা-কেনা করছি। দেশীয় ব্র্যান্ডকে আমরা তুলে ধরতে পারছি। এই দিনে দেশীয় খাবার খাচ্ছি, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে আমরা যা-ই করছি দেশীয় সংস্কৃতির মাধ্যমে একটি বড় উৎসব করছি। এরমধ্যে একদিকে উৎপাদন সংশ্লিষ্ট কর্মকা- বেড়েছে। দেশীয় পণ্যের ব্যাপারেও সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে ও দেশ প্রেম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশাখকে কেন্দ্র অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্য বেচা-কেনা হয়। তবে এর অর্থনৈতিক মূল্য আরও বেশি।
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র প্রসাধনী এবং গয়না বেচা-কেনায়ও ধুম পড়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতা আকর্ষণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ মূল্যছাড় দিয়েছে। কেনাকাটা বেড়েছে অনলাইনেও। হোটেল, রেস্তোরাঁগুলো বৈশাখী সাজে সেজেছে। আয়োজন করেছে নানা প্রকার খাদ্যের। বৈশাখকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানের ফুল বাজারগুলো সরগরম গয়ে উঠেছে। আগের চেয়ে কিছুটা ভাটা পড়লেও এবারও শুভেচ্ছা কার্ড ও বাংলা নববর্ষের ক্যালেন্ডার উপহার দিয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। আমাদের অর্থনীতির জেলা প্রতিনিধিরা জানান, পল্লী অঞ্চলে উৎসবের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। পহেলা বৈশাখের উৎসব সফল করতে মৃৎশিল্পের বিশেষ কারুকাজ, ছবি আঁকা, চিনি ও মিছরির মিষ্টি বানানো, নানা রকম সন্দেশ-মিষ্টি, খৈ তৈরি, কাপড় বোনা ইত্যাদি কাজে উৎসবমুখর পরিবেশ চলছে। এছাড়া ইতোমধ্যে গ্রাম বাংলার মেলাগুলোর জন্য হস্তজাত নানা পণ্যসামগ্রী তৈরি হয়েছে। ছোটদের জন্য মাটির পুতুল, বাঁশের বাঁশি, রঙিন বেলুন, ঢোল, ডুগডুগি, ফিতা, পুঁতির মালা, কাঁচের চুড়ি ও ইমিটেশনের গহনা মেলায় বিক্রি হয়। এই উৎসবে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বিভাগ ও বিভিন্ন জেলা শহরের প্রায় প্রতিটি স্থানেই মাটির পণ্য বিক্রি হবে। সম্পাদনা: রফিক আহমেদ