বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের জন্ম
রাহাত মিনহাজ
১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশেল অভ্যুদ্বয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের এই দিনেই আবার এক আম বাগানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন পথ চলা শুরু হয়েছিল। গঠিত হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। যে সরকারই অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনে। একাত্তরের ১৭ এপ্রিলে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ছায়া ঘেরা আম বাগানের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা সে সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশ ডকুমেন্টসের তথ্য অনুযায়ী সেই দিন দিল্লিভিত্তিক দৈনিক ‘দ্য সানডে স্টেটসম্যান’-এর প্রতিবেদনটি ছিল অনেকটায় এক নিম্নরূপ।
১৮ এপ্রিল নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘দ্য সানডে স্টেটসম্যান’ পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ বিকামস্ এ রিপাবলিক’। যাতে লেখা হয়… ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদদের দলসহ প্রায় ১০ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল অনুষ্ঠান স্থলে। যাদের হর্ষধ্বনির মাধ্যমে পথ চলা শুরু হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের। যার কাঠামো হবে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির।
অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের কিছু প্রশাসনিক ভবন আর ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া পাকবাহিনীর আর কোনো জায়গায় কর্তৃত্ব নেই। প্রায় ৫০ জন বিদেশি সাংবাদিক পুরো ঘটনা কাভার করেন। ঘোষণাপত্রে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে এটাও বলা হয় শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি দায়িত্ব পালন করতে না পারলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক বাহিনী ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিই হবেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তার প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী নিয়োগ করবেন। কর প্রশাসনের ব্যয় নির্বাহ ও সংসদ অধিবেশন ঢাকার কর্তৃত্ব থাকবে তার হাতে। সেই ঘোষণাপত্রে এই সরকার গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। এই সরকার গঠনের পেছনে ৭০ নির্বাচনে জনগণের ঐতিহাসিক রায়ের কথাও তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা বলেন, নতুন রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হবে সামাজিক সাম্য ও মানুষের সম্মান রক্ষা করা। অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার গঠন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পাকবাহিনীর বর্বরতার জন্য তা সম্ভব হয়নি।
অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ে আমাদের এই যুদ্ধ জিততেই হবে। তা আজ হোক, কাল হোক বা অন্য কোনো দিন। একই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষ তার অধিকার চায়, মুক্তি চায়, একই সঙ্গে চায় সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে। সারাবিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে এই বার্তা তুলে ধরতে তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান। একই সঙ্গে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, দেশ রক্ষার নামে পাকিস্তান সরকার যে সব সমরাস্ত্র কিনেছে তাতে বেশি অবদান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে পাক সরকার সেই অস্ত্রই এখন পূর্ব বাংলার নিরীহ মানুষের উপর প্রয়োগ করছে। তিনি বিশ্বের সব দেশগুলোকে পাকিস্তানে নতুন অস্ত্র না পাঠানোর আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি তার নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে সবাইকে আহ্বান জানান। এছাড়া বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানি সাংবাদিকদের বলেন, তার ধারণা কয়েক সপ্তাহে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। এছাড়া ৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের সময় ত্রাণ তৎপরতার সময় বিশ্ববাসী যেসব হেলিকপ্টার পাঠিয়েছিল পাকবাহিনী বাঙালি নিধনযজ্ঞে সেগুলোও ব্যবহার করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের আরও বলেন , তার বাহিনী যদি বহির্বিশ্বের কাছ থেকে অস্ত্র ও অন্যান্য সহযোগিতা পায় তাহলেই অচিরেই তারা পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারবে। তবে তা না হলে এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান বাহিনীর মূল লক্ষ্য বাঙালি জাতির মনোবল ভেঙে দিয়ে তাদের দাসে পরিণত করা। আর এর জন্য তারা যা ইচ্ছা তাই করছে। চট্টগ্রাম বন্দরে তারা সাধারণ মানুষের উপর ১৭ ইঞ্চি বন্দুক ব্যবহার করেছে। এ ধরনের বর্বরতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান