আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অরক্ষিত!
হাবীব ইমন
গুলশান জিম্মি ঘটনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তাদের প্রায় সবার পড়ালেখাটা হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশতে জাতীয় পতাকা উড়ানো হয় না, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। ওখানে সাংস্কৃতিক চর্চাও নেই। অর্থাৎ জাতীয়তাবোধ চর্চা এখানে পুরোপুরি উপেক্ষিত। গুলশানের ঘটনা আমাদেরকে বড় দাগে দেখিয়ে দিয়েছে, এত এত জিপিএ ফাইভের তোড়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা অরক্ষিত, কতটা রক্ষণশীল! যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বলা হচ্ছে, বিশেষ করে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির কথা খুব শোনা যাচ্ছে, ওখানে জঙ্গি বানানো হচ্ছে, তাহলে এগুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ন্ত্রণ কোথায়? বাংলাদেশে প্রায় সব সরকারি কাজে প্রধানমন্ত্রীকেই ‘নির্দেশ’ দিতে হয়। এ এক অদ্ভুত রাজনৈতিক সংস্কৃতি। শিক্ষামন্ত্রী, ইউজিসির চেয়ারম্যান ও উপাচার্যরা থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারেও কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই নির্দেশ দিতে হবে?
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো ছাত্র সংসদ বা কাউন্সিল নেই। প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের কোনো স্পেস সেখানে নেই। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোতেও ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না অনেকগুলো বছর। ছাত্রসমাজের গৌরবময় ইতিহাসের কথা আমরা প্রায়ই স্মরণ করি। বর্তমান ছাত্রসমাজ সেই গৌরবময় ইতিহাস কতটা জানে, আমরা জানি না। জনাব নাহিদের চেয়ে আর কে ভালো জানেন, ছাত্র সংসদের নির্বাচনের গুরুত্ব কতটা।
উচ্চশিক্ষা পরিপূর্ণ করার জন্য দরকার কিছু অনুষঙ্গের, যা একজন বিশ্ববিদ্যলয়-কলেজ শিক্ষার্থীর মানবিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক চর্চার বিকাশ ঘটায়। আর এ অনুষঙ্গগুলোর অধিকাংশই পূরণ করে থাকে ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম পরিচায়ক। জ্ঞানার্জনের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ চলবে ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক সহযোগিতায়। আর এ সহযোগিতার জন্য চাই ছাত্র প্রতিনিধিত্ব, যারা ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলবে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে। এ প্রতিনিধিত্ব করাই ছাত্র সংসদের প্রধান কাজ। ছাত্র সংসদ হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার কোনো একক রাজনৈতিক ব্যানার নেই। ছাত্র সংসদের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছেÑ শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ত্বরান্বিত করা, একাডেমি ও একাডেমির বাইরের বিষয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা অর্জন করা, নেতৃত্ব বিকাশে এবং সত্যিকারের নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা। এ প্রধান চারটি কাজ ছাড়াও ছাত্র সংসদের অধীনে জার্নাল বুলেটিন, পত্রিকা প্রকাশ, বিতর্কের আয়োজন, গান, আবৃত্তি, খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন করা যায় না। কিন্তু উগ্র সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে সেগুলো।
কেউ কেউ গুলশানের ঘটনার পর উচ্ছ্বসিত হয়ে বলছেন, মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে অনেক অপপ্রচারমূলক কথা বলা হয়। কথাগুলো তাদের এককেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক চিন্তা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতাকে উস্কে দেওয়ার জন্য বলা, তা তাদের কথার ঢঙে বোঝা যায়। মাদ্রাসা শিক্ষাকে নিয়ে যেসব কথা হয়, সেগুলো কোনোটাই মিথ্যে প্রমাণিত নয়, তার স্বরূপ আমরা শোলাকিয়া ঘটনায় দেখেছি। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক হামলা, মতিঝিলে হেফাজতের তা-বে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যেটি জানা গেছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে, তারা বলেছেন তাদের হুজুর বা ওস্তাদ বলেছে তাই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অর্থাৎ ভালোমন্দ বোঝার কোনো জ্ঞান তাদের দেওয়া হয় না। ওখানকার অবুঝ-উন্মত্ত ছেলেদেরকেও একইভাবে মোটিভেশন করা হয়। বিভিন্ন ঘটনায় ওদের জঙ্গি কায়দায় আমার মনে এও প্রশ্ন উঠেছে কী ধরনের ধর্মীয় শিক্ষা তারা সেখানে পাচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ সবসময় সংকুচিত। ইহজগত কষ্টে কাটে বলেই পরজগতে বেহেশত তাদের কাছে অধিক লোভনীয়। আর দুর্বল এ সুযোগটিকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে বিপথগামীরা এসব পরিবারের সন্তানদের খুব সহজে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে বেড়ে ওঠা, জেগে ওঠা একটি অপশক্তি এই বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির মর্মমূলে আঘাত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন