ডায়াবেটিক ফুট, ভয়াবহ এক ডায়াবেটিক জটিলতার নাম
ডা. জাকির হোসেন
মানব শরীবের মেটাবোলিক এন্ড্রোক্রাইন রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে আক্রান্ত রোগের নাম হলো ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস হলে রোগীর শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো সবার আগে আক্রান্ত হতে শুরু করে যেমনÑ হৃদপি-, চোখ এবং শরীরের স্নায়ুতন্ত্র। আমাদের শরীরের অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ ‘পা’। পা ছাড়া গতিময় মানুষের জীবন একেবারেই অচল। কিন্তু এই পায়ের যতœ সবচেয়ে বেশি নেওয়ার প্রয়োজন হলেও আমরা সবাই পা কে একটু বেশিই অবজ্ঞা করি। পায়ের কোনো সমস্যা হলে সহসাই চিকিৎসকের কাছে আমরা যেতে চাই না। অথচ শরীরের অন্য কোনো স্থানে কোনো সমস্যা হলে তাড়াহুড়ো করে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যাই। আমাদের দেশে যে পরিমাণ সময় রূপচর্চায় ব্যয় হয় তার থেকে একটু সময় বের করে পায়ের যতœ নেওয়া অত্যাবশক। এই প্রয়োজনীয়তা আবার একজন ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে পুরো উল্টো। মুখের যতেœর চেয়ে পায়ের যতœ বেশি নেওয়াই হলো তার অন্যতম ডায়াবেটিক কেয়ার। কারণ ডায়াবেটিক রোগীর শরীরে যে সকল জটিলতা তৈরি হয় তন্মধ্যে পায়ের জটিলতা অন্যতম। এই জটিলতাকে মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় ডায়াবেটিক ফুট বলা হয়। এই ‘ডায়াবেটিক পা’ (উরধনবঃরপ ঋড়ড়ঃ) একটি ডায়াবেটিস রোগজনিত পায়ের রক্তনালীর জটিলতা। ১৫% ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এই জটিলতা দেখা দিতে পারে। একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় পৃথিবীতে যত রোগীর পা কাটা লাগে তার মধ্যে ৮৪% হলো ডায়াবেটিক পা।
ডায়াবেটিস রোগীর পায়ে সামান্য পরিমাণ কোনো আঘাত লাগলে কিংবা ক্ষত হলে পায়ের ক্ষুদ্র রক্তনালীর বিকাশ, কোলাজেন, এক্সট্রাসেলুলার ম্যাট্রিক্স, ত্বক ইত্যাদির বৃদ্ধি খুবই ধীরগতিতে সম্পন্ন হয়। পা হৃদপি- থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে রক্তের প্রবাহ শরীরের উপরিভাগের চেয়ে অনেক কম। আবার ডাযাবেটিক রোগীর রক্তে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকায় সেই চর্বি রক্তনালীতে জমে রক্তনালী আস্তে আস্তে সংকোচিত হতে থাকে। শরীরবৃত্তীয় এই গঠনের ফলে পায়ের ফলে ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং ক্ষত শুকাতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। দীর্ঘ সময় ক্ষত ভালো না হওয়ার কারণে পায়ে জীবানু সংক্রমণের সম্ভাবনা বহু গুনে বেড়ে যায়। রোগীর পায়ের যতেœ অবহেলার কারণে অনেক সময় ক্ষতস্থানে দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পচন ধরে যায়। একে মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় এধহমৎবহব (গ্যাংগ্রিন) বলে। এই পর্যায়ে রোগীর জীবন রক্ষার্থে অনেক সময় পা বা পায়ের কিছু অংশ কেটে বাদ দিতে হয়। একবার পা কাটা শুরু হলে তা আবার আস্তে আস্তে উপরের দিকে বাড়তে থাকে। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরো পা কেটে ফেলে দিতে হয়। যে সকল ডায়াবেটিক রোগী আবার ধুমপান করে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে পায়ের জটিলতা আবার আরও বহু গুনে বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি ডায়াবেটিক রোগী যখন চিকিৎসকের নিকট আসে তখন থাকে আমরা খুব ভালোভাবে শিখিয়ে দিই কিভাবে সে প্রতিদিন পায়ের যতœ নিবে। বিশেষ করে তার পায়ের জুতা কেমন হবে, কখন জুতা কিনতে হবে, কোনো আঘাত পেলে সঙ্গে সঙ্গে কী করতে হবে, পায়ে কোনো কিছুর আঘাত টের না পেলে কী করতে হবে ইত্যাদি।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বেশির ভাগ রোগীই পায়ের যতেœর ক্ষেত্রে বেশ উদাসীন। তাছাড়া সে নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা নিতে আরও বেশি উদাসীন। যার ফলে বেশির ভাগ রোগীর পায়ের জটিলতার এমন পর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে আসে যখন পা কেটে ফেলা ছাড়া চিকিৎসকের আর কোনো উপায় থাকে না। আমরা চিকিৎসকেরা একটা কথা রোগীকে প্রায়ই বলি আপনি মুখ আয়না দিয়ে না দেখে প্রতিদিন একবার হলেও নিজের পায়ের পাতা আয়না দিয়ে দেখবেন। ডায়াবেটিক ফুট ভয়াবহ জটিলতার নাম। তাই সকল ডায়াবেটিক রোগীর উচিত চিকিৎসকের কথার গুরুত্ব দেওয়া এবং সে অনুসারে স্বীয় পায়ের যতœ নেওয়া।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান