অন্যের ঢাল তলোয়ার আশ্রয় হবে কেন?
আলমগীর স্বপন
কথায় আছে, ব্রিটিশ চলে গেছে, কিন্তু তার ছালবাকল এখনও থেকে গেছে। ঔপনিবেশিক মনোজগত কী? এই কথাতেই স্পষ্ট বোঝা যায়। একটু ব্যাখ্যা করে বলা যায়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে আমরা মুক্ত হলেও তাদের রেখে যাওয়া মতাদর্শিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও ধ্যান-ধারণা এখনও টিকে আছে আমাদের মননে ও মগজে। তাই যতটুকু সামর্থ্য আছে তার ওপর ভরসা-বিশ্বাস না রেখে আমরা এখনও মনে করি বিলেতিরাই আমাদের সভ্য করে গেছে। এভাবে শুধু বিলেতি নয় আমরা হরহামেশাই অপরের শক্তিতে নাচানাচি করি, স্বপ্নে লাড্ডু খাই।
এর সদ্য উদাহরণ হতে পারেÑ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকার একটি খেলার সংবাদ। পত্রিকাটি লিখেছে, হাইতির কল্যাণে এবারের শতবর্ষী কোপা আমেরিকা ফুটবলে নাকি একটু হলেও বাংলাদেশের ছোঁয়া আছে! এর কারণ নাকি বাংলাদেশে খেলে যাওয়া সনি নর্দের হাইতির পক্ষে ইকুয়েডরের বিপক্ষে মাঠে নামা। এভাবে আমরা মননে-মনস্তত্বে অপরের শক্তিতে অহেতুক নিজেদের জয় দেখছি। বুঝছি না যে, কোপা আমেরিকা ফুটবলের সঙ্গে বাংলাদেশ কেন এশিয়া, ইউরোপ কোনো মহাদেশেরই আপাতত ছোঁয়াছুঁয়ির সুযোগ নেইÑ অন্তত মাঠের খেলায়।
এই খবর যখন পড়ছিলাম এর আগে থেকেই মাথায় ঘুরছিল ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআইর একটি সংবাদ। তারা বলেছে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দুজন নেতা সাম্প্রতিক সংখ্যালঘু হত্যাকা- বন্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। খবরটা পড়লে একজন বাংলাদেশি হিসেবে একটু খটকা লাগবেই। কারও কারও বেজায় ক্ষোভও হতে পারে। ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশ সরকারের সামর্থ্যরে ওপর আমাদের ভরসা রাখা উচিত। কিন্তু ওই যে আমাদের ঔপনিবেশিক মন, ‘আপনকে পর ও পরকে আপন জ্ঞান করার বিকৃতি’ লব্ধ পরজীবী চিন্তা-এর থেকে আমরা বের হতে পারছি কি? তবে এক্ষেত্রে সম্ভবত ইজ্জত রক্ষা করা গেছে। সোমবারের খবরের কাগজে বেরিয়েছে পিটিআই যাদের বরাত দিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সংবাদ প্রকাশ করেছে, তা অস্বীকার করেছেন সেই দুই নেতা। যাক সংবাদটি মিথ্যা বা বিষয়টি তাদের বুঝে এসেছে এটাই বড় কথা। কিন্তু এ ঘটনা না হয় গেল, আমাদের ঔপনিবেশিক মনের উচাটন ভাব কিন্তু হরহামেশাই এমন উথালপাথাল করে উঠে।
দেশে মুক্তমনা লেখক-প্রকাশক-ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী শুধু নয় ইমাম-ধর্মযাজক-পুরোহিত কেউ এখন নিরাপদ নয়। একের পর এক হত্যাকা- ঘটছে। কিন্তু আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্ণধার বলছেন, আমেরিকা ইউরোপেও এমনটা ঘটে। সার্বিকভাবে আমরা নিরাপদে আছি। এভাবে, ‘ওদের ওখানে ঘটলে, আমাদের এখানে ঘটলে দোষ কি’? জাতীয় মনোভাব থেকে আমরা বের হতে পারছি না। ‘বৃষ্টিতে অপরের ছাতায় ঠাই নেওয়ার’ এ ধরনের ঔপনিবেশিক চিন্তার শেকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে সামনে আরও বড় বিপদ। তাই প্রশ্ন তোলা এখন জরুরি। মৌলবাদ ও ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে যে দেশের হাজার বছরের রুখে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি, সে দেশ কেন অন্যের ঢাল তলোয়ারের আশ্রয় নিবে?
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টিভি
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন