কাক্সিক্ষত সেবা না দিয়ে পদমর্যাদা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা কেন?
সরকারের প্রতিটি বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ভাতা জনগণ প্রদত্ত কর হতে নির্বাহ করা হয়। সরকারের প্রতিটি বিভাগেরই প্রধান কাজ দেশের জনসাধারণকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা প্রদান। কিন্তু এ কথাটি আজ অনস্বীকার্য যে, সরকারের প্রায় সকল বিভাগ হতেই জনসাধারণ কাক্সিক্ষত সেবা প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সর্বশেষ ঘোষিত বেতন স্কেল অনুযায়ী যে বেতন ভাতা দেওয়া হচ্ছে তাতে কোনো বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অবকাশ কম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বেতন স্কেল ঘোষণার আগে যারা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন নতুন বেতন স্কেলের বর্ধিত বেতন ভাতা তাদের দুর্নীতির মাত্রার এতটুকুও হ্রাস ঘটাতে পারেনি।
সরকারের প্রতিটি বিভাগের শীর্ষ পদধারীর পদমর্যাদা কি হবে তা আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটি একটি স্থায়ী মীমাংসিত বিষয়। আমাদের দেশেও দীর্ঘকাল যাবৎ এটি একটি মীমাংসিত বিষয় ছিল। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের পদমর্যাদার মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে সচিবালয় সংশ্লিষ্ট সচিবের পদটিকে বেসামরিক সর্বোচ্চ পদ হিসেবে ভিত্তি ধরা হয়। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব বা মূখ্য সচিব মূলত একজন সচিব হলেও পদমর্যাদার দিক দিয়ে তিনি সচিবদের শীর্ষে এবং সে বিবেচনায় অপরাপর সচিবের চেয়ে তার বেতন সামান্য বেশি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরবর্তী আমাদের সেনা প্রধান মেজর জেনারেল পদধারী ছিল। অপর দুটি বাহিনী যথা নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদ্বয়ের পদমর্যাদা মেজর জেনারেল সমমানের ছিল। পরবর্তীতে প্রথমত সেনা প্রধানের পদমর্যাদা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং অতঃপর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। এটি সেনাবাহিনীর ন্যায় নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদ্বয়ের ক্ষেত্রেও অবশেষে কার্যকর করা হয়।
সেনাপ্রধান যখন মেজর জেনারেল পদমর্যাদাধারী ছিল তখন বর্তমানের ন্যায় এটি সচিবের পদের সমতুল্য ছিল। সেনাপ্রধানের পদমর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সচিবদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং তারা তাদের পদমর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে সোচ্চার হন। এরই এক পর্যায়ে দেখা গেল, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিবের বেতন স্কেল ও পদমর্যাদা সেনাবাহিনীর জেনারেল সমমানের করা হয় এবং কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিবের পদকে সিনিয়র সচিব পদে উন্নীত করে এদের পদমর্যাদা ও বেতন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এর সমমানের করা হয়।
আদি সচিব পদবি নামধারীদের পদবি ও বেতন আগেকার ন্যায় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল এর সমতুল্য রাখা হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানের বেসামরিক সর্বোচ্চ সচিবের পদকে ভিত্তি ধরেই অপরাপর বিভাগের সর্বোচ্চ পদধারীদের পদমর্যাদা ও বেতন নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে দেখা গেল, সেনাপ্রধানের পদমর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সেটিকে ভিত্তি ধরে বেসামরিক সচিব পদকে উচ্চতরে অবস্থানে নেওয়া হয়েছে। আমাদের সচিবালয়ে কর্মরত সিনিয়র সচিব ও সচিবদের কাজের পরিধির মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। দেশের ন্যায় পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সিনিয়র সচিব নামক কোনো পদের অস্তিত্ব নেই।
আমাদের পুলিশবাহিনী প্রধানের পদমর্যাদা বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টি পরবর্তী দীর্ঘকাল যাবৎ অতিরিক্ত সচিবের সমতুল্য ছিল। অতঃপর প্রথমত এটিকে সচিবের পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয় এবং পুলিশ বিভাগের আরও কতিপয় উচ্চতরপদ সচিবের পদমর্যাদাসম্পন্ন করা হয়। এতক্ষণে পুলিশ বিভাগের পক্ষ হতে দাবি উঠেছে এ বাহিনীর প্রধানকে সেনাবাহিনীর জেনারেল এর সমমর্যাদায় উন্নীত করার এবং তাদের এ দাবিটি যে পূরণ হতে যাচ্ছে এটি নিশ্চিত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, পররাষ্ট্র সচিব ছাড়াও বিশেষ বিশেষ দেশ বা সংস্থায় রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার বা স্থায়ী প্রতিনিধি পদে নিয়োগ প্রাপ্তদের পদমর্যাদা সচিব বা ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিমন্ত্রীর সমতুল্য করা হয়েছে।
বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় ৪৫ বছর ব্যাপ্তিকালে এ দেশটি যে পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল তা সম্ভব না হওয়ার পিছনের মূল যে কারণ সেটি হলোÑ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের শীর্ষ পদধারীদের মধ্যে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের চেয়ে নিজেদের পদমর্যাদা ও সুযোগসুবিধার উন্নয়ন প্রাধান্য পেয়েছে। আর এভাবে সরকারের শীর্ষ পদধারীরা পদমর্যাদা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকলে তাদের ভাগ্যোন্নয়ন ঠিকই ঘটবে কিন্তু দেশ ও জনগণ একদিকে কাক্সিক্ষত সেবা প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হবে অপরদিকে উভয়ের দুঃখদুর্দশা প্র[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশলম্বিত হতে থাকবে।
লেখক : সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন