পাসের হার কমলো প্রায় ৮ শতাংশ মাধ্যমিকে পাসের হার কমলেও ফলাফল বিপর্যয় নয়
নাশরাত আর্র্শিয়ানা চৌধুরী ও তরিকুল ইসলাম সুমন : মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার বিগত বছরের তুলনায় চলতি বছর পরীক্ষা পদ্ধতি ও খাতা মূল্যায়নসহ নানা উদ্যোগের ফলে পাসের হার কমেছে। পাশাপাশি কমেছে পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যাও। শিক্ষার্থীদের পাসের হার কম হওয়ার কারণে আনন্দ উচ্ছাসেও এ বছর কিছুটা ভাটা পড়েছে। এ ফলাফলেও প্রভাব পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ পরিবারের উপর।
এবার ফলাফল অন্যান্য বছরের তুলনায় খারাপ হওয়ার পেছনে কারণও চিহ্নিত করেছে সরকার। সেখানে বলা হয়েছে, পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের মূল কারণ নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন। প্রশ্নফাঁস রোধ ও পরীক্ষা কেন্দ্রে কড়াকড়ির কারণেও আগের বছরের চেয়ে কম পাস করেছে। তবে ফলাফল বিপর্যয় মনে হলেও আসলে বিপর্যয় নয়, এ বছর সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। বিশিষ্টজনরা বলেছে, ফলাফল বিপর্যয় মনে হলেও আসলে বিপর্যয় নয়। গুনগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই হিসাবে এগুতে হবে।
পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাইয়ের নতুন সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত সময়োচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এতে পাসের হার কিছুটা কমে গেলেও পরীক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ে এটি যথার্থ কার্যকরী হবে। তিনি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি সংযুক্ত করায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানান। নতুন পদ্ধতিতে পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র তৃতীয় পরীক্ষক দ্বারা পরীক্ষা করানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার একটি দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে তুলতে প্রতিটি শিশুরই শিক্ষায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে চায়।
মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় এবার দশ বোর্ডে গড় পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত বছর গড় পাসের হার ছিল ৮৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। এবার পাসের হার ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ কমেছে। বিগত ৫ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ২০১৩ সালের ফলাফলে পাস করেছিল ৮৯ দশমিক ০৩ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৯১ দশমিক ৩৪, ২০১৫ সালে ৮৭ দশমিক ০৪, ২০১৬ সালে ৮৮ দশমিক ২৯ শতাংশ পাস করেছিল। মাধ্যমিক (এসএসসি ও সমমান) পরীক্ষায় গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হারের সঙ্গে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন। এবার জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৫ হাজার। এছাড়াও পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই পাসের হার সবচেয়ে কম।
শিক্ষামন্ত্রী এ বছর পাসের কমে যাওয়া ও কম পাস করার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, আগে পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের পদ্ধতি খুবই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এ কারণে পাসের বিষয়ে ব্যাপক তারতম্য হতো। চলতি বছর নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করায় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় তুলনামূলকভাবে অন্য বছরের চেয়ে বেশি ফেল করেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ঢালাওভাবে পরীক্ষার্থীদের পাস করানোর বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার লাগাম টেনেছে। এটি ফলাফল বিপর্যয় নয় বরং সরকারের একটা ভালো দিক। আগে ঢালাওভাবে পাস করলেও ভালো কোনো জায়গায় ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতো। শিক্ষার মান রক্ষার জন্য বর্তমানে যে পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হচ্ছে সেটি একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এ বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে গবেষণা চলছে। শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের এটি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। আগামীতে আরও পরিবর্তন আসবে।
অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। শুধু পাস করলে হবে না, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। এই ক্ষেত্রে কত ভাগ পাস করলো সেটা মুখ্য বিষয় নয়। গুণগত মানের ও উন্নতমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য সরকারকে আরও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের মূল কারণ নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন। প্রশ্নফাঁস রোধ ও পরীক্ষাকেন্দ্রে কড়াকড়ির কারণেও আগের বছরের চেয়ে কম পাস করেছে। তবে ফলাফল বিপর্যয় মনে হলেও আসলে বিপর্যয় নয়, এবছর সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বোর্ডগুলো বেশকিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধান পরীক্ষকদের উত্তরমালা প্রণয়নের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সাধারণ পরীক্ষকদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের গুণগতমান যাচাইয়ের জন্য প্রশ্নমালা সব প্রধান পরীক্ষককে সরবরাহ করা হয়েছে। এ কারণে এবার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের আগে এসএসসি ও এইচএসসিতে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। ফলাফল কবে হবে সেটারও কোনো সময়সীমা ছিল না। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমরা এসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা নিয়ে এসেছি। এ বিষয়টি উপলব্ধি করে গত ৩ বছর ধরে বিইডিইউ (বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট) ধরে কাজ করে। গবেষণা করে, বিভিন্ন জায়গায় খাতা দেখে, শিক্ষকরা খাতা মূল্যায়ন করে তা দেখে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।
উদাহরণ হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, একটা খাতা বাছাই করে ২০টি কপি করে ২০ জন শিক্ষককে দেওয়া হলো। দেখা গেল খাতায় ২০ ধরনের নম্বর দেওয়া হয়েছে। ১০ এর মধ্যে কেউ দিয়েছেন ৮, কেউ ৬, কেউ ৫, কেউ ৭ নম্বর। এমন তারতম্য যাচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, অনেক সময় শিক্ষকরা মোটামুটি দেখে অনুমান করে একটা নম্বর দিয়ে দেন। যখন দিতেন মনে করতেন না দেখে দিচ্ছি যা হোক একটা নম্বর দিয়ে দেই, হয়তো এমন হতে পারে। বা কম পেয়ে যেতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়নের ফলে ছেলেমেয়েদের নম্বরের যে তারতম্য যাচ্ছে এর প্রভাব পড়ছে তার ফলাফলে। একজন হয়তো ভাল লিখেও কম নম্বর পেয়েছে। আবার কেউ ভাল না দিলেও বেশি নম্বর পেয়ে গেছে। এটা সত্যিকার অর্থে মূল্যায়ন নয় কিংবা যাচাই করে একজন শিক্ষার্থীকে আমার সঠিক ফলাফল দিতে পারছি নাÑ বলেন নাহিদ।
তিনি বলেন, এটা থেকে বেরিয়ে আসতে আমরা প্রধান পরীক্ষকদের ওই মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রস্তুত করেছি, একটা ট্রেনিংও দিয়েছি। তাদের অধীনে যে পরীক্ষক তাদেরও সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। এবার পরীক্ষায় বাস্তবে প্রয়োগ করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা অগ্রসর হই। পদক্ষেপ যখন আমরা নিতে গেছি তখন ভাল করে বুঝতে পারছি এটার একটা প্রভাব হয়তো আমাদের ফলাফলে পড়তে পারে।
উল্লেখ্য, দেশের ৮টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে এসএসসিতে এবার ১৪ লাখ ২২ হাজার ৩৭৯ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। পাস করেছে ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৮ জন। মাদ্রাসা বোর্ডে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩৪৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে এক লাখ ৯৩ হাজার ৫১ জন। কারিগরি বোর্ডে এক লাখ ৬ হাজার ২৩৯ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮৩ হাজার ৬০৩ জন।