হাওরের সৌন্দর্য ফিরবে তো?
মিঠুন মিয়া : বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাতটি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে হাওর এলাকা। সাত জেলার প্রায় ৩৪ উপজেলায় ৪১১টি ছোট বড় হাওর এলাকাকে ভাটি এলাকা বলা হয়ে থাকে। হাওর এলাকা দেশের অন্য এলাকা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জীবনযাত্রা, ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সবকিছুই অন্য এলাকা থেকে ব্যতিক্রম। অপরূপ সৌন্দর্যের বিচিত্র লীলাভূমি বাংলার রূপের রানী হাওর যেন সাগরের ছোট বোন। বর্ষার অথৈ জলে হাঁস ও মাছেরা প্রাণখুলে খেলা করে। ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে অবিরাম ছুটে চলে জেলেদের ছোট ছোট নৌকা। জলের বুকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা নলখাগড়া, করচ ও হিজলের বনের নয়নাভিরাম দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় শুধু জল আর জল। ভাটির সাধক পুরুষ শাহ আব্দুল করিমের কথা ও সুরে উঠে এসেছে হাওরের পরিচয়। একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে নানা শঙ্কায় দিন কাটে হাওরবাসীর। দিনেদিনে বেড়ে তোলা বিস্তীর্ণ মাঠের সোনালি ফসল ঘরে তুলতে না পারার ভয় সর্বদা তাড়া করে হাওরের মানুষদের। কিন্তু এবার আর রক্ষা হলো না হাওরবাসীর। বিগত ৪০ বছরে এবারের মতো বন্যা দেখেনি তারা। পুরো হাওরে এখন অসময়ের বন্যার থৈ থৈ পানি। অকল্পনীয় বন্যায় বিপর্যস্ত হাওরের মানুষ। প্রতিদিনের দেখা সন্তানতুল্য সোনালি ফসলগুলো নিমিষেই তলিয়ে গেছে। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নিয়েছে আকস্মিক বন্যা। তলিয়ে যাওয়া ধান রোদে পচন ধরে পানি দূষিত হয়ে ব্যাপকহারে মাছে মড়ক লেগেছে। সেই ফসল পানির নিচে থাকায় পচে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশাখের প্রচ- উত্তাপ। এতে অক্সিজেনের স্বল্পতায় মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। এখন ভাবনার বিষয় একটি, ব্যাপক এই ক্ষতি পুষিয়ে কবে হাওরের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফিরে আসবে। ভ্রমণপিপাসু মানুষ হাওরের রূপ দেখলে তার প্রেমে পড়ে যেত। কিন্তু আজ হাওরের সেই রূপ নেই। হাওরজুড়ে এখন হাহাকার। বর্ষার রূপ যেমন মোহনীয় তেমনি শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের আগমণে হাওরাঞ্চল হয়ে উঠত সৌন্দর্যের লীলাভূমি।
দেশ-বিদেশের নানান প্রজাতির রঙ বেরঙের অতিথি পাখি আসে। কিন্তু এবার হাওরে কি বিরল প্রজাতির লালঝুঁটি, ল্যাঞ্জা হাঁস, খুন্তে হাঁস, টিকি হাঁস, পিয়াং হাঁস, ধলা বালি হাঁস, বেগুনি কালিম, পান মুরগি, সরালি, রাজ সরালি, পাতি মাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা ও চখাচখির দেখা পাওয়া যাবে? ‘মাছে ভাতে বাঙালি‘ এ কথাটি আজও হাওরের মানুষদের বেলায় শতভাগ প্রযোজ্য। হাওরের মিঠা পানির মাছের স্বাদই আলাদা। কিন্তু এবারের বন্যায় মাছসহ নানা প্রজাতির জলজ প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। মাছের প্রজননেও ব্যাপক আঘাত এসেছে। যেভাবেই হোক হাওরের সৌন্দর্য পুনরুদ্ধার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, হাওরের এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নিতে হবে। একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসন অন্যদিকে হাওররের সৌন্দর্য ফেরানো গুরুত্বপূর্ণ। সরকার হাওরের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। হাওর ফের হয়ে উঠুক জীবন-জীবিকার উৎস। ফিরে আসুক হাওরের সৌন্দর্যÑ এমনটিই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান