বিএনপির ভিশন-২০৩০ : মিষ্টি কথার সমাহার
বিএনপি ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেছে। তাদের ঘোষণাপত্রে অনেক মিষ্টি কথার সমাহার দেখতে পাচ্ছি। সাধারণ মানুষ বলেন, মিষ্টি কথায় আর এখন চিড়া ভিজে না। এর জন্য পানির দরকার হয়। বিএনপি অতীতেও ক্ষমতায় ছিল, এখনো রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণ করছে। প্রশ্ন হলো, শুধু মুখে ভালো ভালো কথা নয়, ঘোষিত এই ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়ন তাদের পক্ষে কতটুকু সম্ভব হবে? এর উত্তর আমরা সবাই জানি। তাদের কাছে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন প্রধান বিষয় নয়, কিছু ভালো কথা বলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং ক্ষমতায় যাওয়াই মূল বিষয়।
একাত্তরের ঘাতকদের সঙ্গে নিয়ে জোটের রাজনীতি করা বিএনপি ইংরেজিতে ব্যানার ঝুলিয়ে সংবাদ সম্মেলনে যে ভিশন ২০৩০ প্রকাশ করল, তা দেশের আমজনতা কতটুকু বুঝল তার চেয়ে বিদেশিদের কাছে মডারেট দল হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি তুলে ধরাই প্রধান লক্ষ্য বলে কেউ কেউ মনে করেন।
এই ভিশনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চলমান প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো কথা নেই। সাম্প্রদায়িকতা প্রত্যাখ্যান, বর্জন ও এদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভিত্তির উপরে ফেলার কোনো কথা তিনি বলেননি। এগুলো না করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। বলা হয়েছে ‘জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে চায় বিএনপি’, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজনের অবসান ঘটাতে চায়’, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার কথাও বলা হয়েছে এই ভিশনেÑ এ রকম আরও অনেক কথা। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের অর্থনৈতিক ধারা পরিত্যাগ করে মুক্তবাজারের নামে তাদের অর্থনৈতিক ধারা চালু করেছিল। সে ধারা এখনও বহমান রয়েছে।
বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রধান করে যে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কথা বলা আছে তাও তারা মানেন না। দেশের মালিকানা এখন পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবার থেকে ২২ হাজার পরিবারের হাতে চলে গেছে। এরা বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাতীয় পার্টিতে জড়াজড়ি করে আছে। এদের অব্যাহত রেখে দেশের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবেন কিভাবে?
কিভাবে বৈষম্যের অবসান ঘটাবেন? রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিÑ জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র। বিএনপির নব্য আবিষ্কার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে পাকিস্তানি মুসলিম বাংলার ‘ভূত দর্শন’ এর মতো। তাই এর ভিত্তিতে দেশের রাজনৈতিক সামাজিক বিভাজনের অবসান ঘটানোর আকাঙ্খা কাল্পনিক অথবা নিজেদের ভোটব্যাংক ঠিক রাখতে দেশের একাংশ মানুষের বিভাজন দূর করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
ভিশনের মধ্যে উন্নয়নের অনেক ফিরিস্তি আছে, কিন্তু প্রকৃত উন্নয়নের অন্যতম দৃষ্টিভঙ্গি হলো এর পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাব। চাই পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন প্রক্রিয়া। মুক্তবাজারের নামে লুটপাটতন্ত্রের অর্থনৈতিক কর্মকা- বহাল রেখে, প্রচলিত দল ও আমলাতন্ত্র বহাল রেখে মোটেই তা সম্ভব না।
ধরুন, সম্প্রতি ব্যাংক আাইন সংশোধনের নামে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে পরিবার তন্ত্রের হাতে আরও জিম্মি করে ফেলা হলো। অবাধ লুটপাট চালানোর সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হলো। বর্তমান অর্থনৈতিক ধারার পরিবর্তন না করে এই অবস্থার পরিবর্তন করবেন কি ভাবে? একেবারেই এরা করতে পারবে না। বরং এই ধারার বিস্তৃতি ঘটানো হবেÑ অতীতের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে।
অনেক কথা বলা যায়, এসব বাদ দিলাম। ভিশন ২০৩০ এর শেষ দিকে বলা হয়েছে, ‘পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং পানীয় স্বাস্থ্যসম্মত ও দৃষ্টিনন্দনভাবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পরিবেশনে উৎসাহিত করা হবে।’ খাবার পরিবেশন যাই হোক না কেন। অনেক দিন ধরে ভোটের বিবেচনায় বড় বড় দলগুলোর মধ্যে যে কূটতর্ক, এমনকি গালাগালির সংস্কৃতি চলছে, এ ধরনের ভিশন প্রকাশের মাধ্যমে এই অপসংস্কৃতির কিছুটা অবসান ঘটিয়ে যুক্তিতর্কের সুস্থধারা যদি ফিরে আসে তা মানুষের স্বস্তি বাড়াবে।
প্রশ্ন উঠেছে, এটা বিএনপির নির্বাচনি ইশতেহার কি না। আমার তো মনে হয় নির্বাচনকে সামনে রেখে, দলীয় বিভাজন কাটিয়ে তাদের সমস্ত দলীয় কর্মীকে মাঠে নামাতে, চমক দিকে আরও কিছু দলকে কাছে টানতে ভিশন প্রকাশ করা হলো। আওয়ামী লীগ নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দিয়েছে এ ব্যাপারে। আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগ যদি রূপকল্প দিত বিএনপি একই রকম প্রতিক্রিয়া দিত। এটাই হচ্ছে এসব দলের বর্তমান বাস্তবতা। এটা নিয়ে মন্তব্যের কিছু নেই।
বরং আমি মনে করি জনগণকে শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, লুটপাট, গণতন্ত্রহীনতা আর বৈষম্যের যে ধারা অনেকদিন ধরে চলছে তার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। মুক্তি পেতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিকল্প শক্তির সমাবেশ ও জনগণের ঐক্য গড়ে তুলে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নতুন ভিশন রচনা করতে হবে। তাহলে ওই ভিশন বাস্তবায়নে মানুষ সক্রিয় হবে। যার মধ্যে থাকবে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ।
পরিচিতি : কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সিপিবি
অনুলিখন : তানভীন ফাহাদ
সম্পাদনা : আশিক রহমান