আপনি ধর্ষক, না সহযোগী!
রাশিদ রিয়াজ
এটা খুব লজ্জার যে একজন নারী নির্যাতিতা হবেন ও তার পাশে সমাজে আরেকজন পুরুষ নিশ্চুপ থাকবেন। বনানীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের পর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও চায়ের টেবিলে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, ওই মেয়ে দুটি অত রাতে হোটেলে বার্থডে পার্টিতে গিয়েছিলেন কেন? এ ধরনের কেন প্রশ্নের উত্তর আমাদের সমাজে বিবিধ রকমের নারী নির্যাতনের জড়িয়ে আছে। হাসপাতালে যখন চিকিৎসক রোগিনীকে ধর্ষণ করেন, যখন একটি শিশু মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়, যার ওপর পর্দা এখনো ফরজ হয়ে ওঠেনি তখন ধর্ষককে আড়াল করতেই আমাদের সমাজে ঘুরে ফিরে নির্যাতিতা নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করার একটা বিকৃত মানসিকতা কাজ করে। এতে ধর্ষকরাই কেবল উৎসাহিত হয়, আমরা জেনে বুঝে তবুও নির্যাতিতার পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস রাখি না।
বনানীর ধর্ষকের পিতা যেভাবে একটি জাতীয় দৈনিকে পুত্রের ধর্ষণের (তার ভাষায় আকাম) অকপট সাফাই গেয়ে বক্তব্য রেখেছেন এবং নিজেও এ ধরনের আকামে অভ্যস্ত বলেছেন, তারপরও তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন, এটিও এক বিরাট প্রশ্ন। অভিভাবক হিসেবে তিনি নিজেও তার পুত্রকে ধর্ষক হিসেবে গড়ে তুলেছেন ও গড়ে উঠেছেন। তাদের দ্বারা এ সমাজে অসংখ্য নারী নির্যাতিতা হলেও বলার কিছুই নেই। কারণ আইনের শাসন ধনীদের বিরুদ্ধে ভোঁতা হয়েই থাকতে দেখা যায়।
৭ মে বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরের প্রথম ৩ মাসে ১৪৪টি শিশু ধর্ষিত হয়েছে। প্রতিবেদনে গত কয়েক বছরে ধর্ষণের খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৬ সালে ৪৪৬, ২০১৫ সালে ৫২১, ২০১৪ সালে ১৯৯, ২০১৩ সালে ১৭০, ২০১২ সালে ৮৬ জন শিশু ধর্ষণ হয়। এ প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, শিশু ধর্ষণের পরিমাণ বাড়ছে। এছাড়া নারী ধর্ষণ ও যেসব ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে থানায় মামলা হয় না বা অগোচরেই থেকে যায় সে সংখ্যাও কম নয়। যদি সব ধরনের ধর্ষণের সংখ্যা হিসেবে আসত তাহলে সঠিক উপলব্ধি করা যেত সমাজে এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ কি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আপনি চিন্তা করে দেখুন, প্রতি মাসে ৪৮ জন শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। যদি ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ধর্ষণের সংখ্যা হিসেবে আনলে গড়ে অন্তত যেকোনো পুরুষ একটি ধর্ষণের জন্য দায়ী হতেন। তার মানে আমি, আপনি এবং সকল পুরুষ ধর্ষণের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিয়ে আমরা যখন গর্ব করি তখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে এভাবে ধর্ষণের পর আমাদের মাথা হেট হয়ে আসে না এবং আমরা রুখে দাঁড়াতে জানি না। ফলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকে এবং থাকবে। ইদানিং পুলিশও ধর্ষণ মামলা নিতে চায় না। ধর্ষিতা থানায় বসে থাকে মামলা গ্রহণের অপেক্ষায়, পুলিশ পরামর্শ দেয়, জানাজানি হলে বিয়ে হবে না, মামলা করে কি হবে?!
ধর্ষকের বিচার এদেশে হয় না। কারণ তার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, অভিভাবকের অর্থের প্রতিপত্তি ও এ ধরনের ঘটনায় বেনিফিশিয়ারি হওয়ার সুযোগ নেওয়া হয়। যারা ধর্ষণের মতো ঘটনায় নির্যাতিতাকে আইনি সহায়তা দিতে চান না তারাও এ ধরনের অপরাধে সমান অপরাধী। যে ধরনের প্রযুক্তি পুলিশের হাতে আছে তাতে ধর্ষকরা কোথায় কার ছত্রচ্ছায়ায় অবস্থান করছে তা জানা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার কিংবা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পুলিশ তা করে উঠতে সমর্থ নয়।
মিডিয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে সঠিক কি ধরনের আচরণ করতে হয় তা শিখে উঠতে পারেনি। একজন টিভি রিপোর্টার নির্যাতিতা মেয়ের বাড়ির সামনে গিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে, এটা কি ধর্ষিতা মেয়ের বাড়ি? রিপোর্টারটি কিভাবে এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরিতে প্রশ্ন করতে না শিখলেও স্বনামধ্যন্য এডিটররা তাদেরকে কি দয়া করে শিখাতে পারেন না ক্যামেরার সামনে কিভাবে এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরির জন্য ফুটেজ সংগ্রহ করতে হবে। আর কেনই বা বনানীর হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে নিয়ে প্রতিবেদনে এত উৎসাহ, যার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই দেশের আনাচে কানাচে অন্যান্য ধর্ষণ ঘটনা নিয়ে? এর কারণ কি অধিকাংশ সাংবাদিক পুরুষ?
আপনি বাস, ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহনে চলাচলের সময় দেখবেন কিভাবে নারীদের প্রতি উস্কানিমূলক আচরণ করা হয়। কিভাবে অনাবশ্যক হলেও বাসের হেলপার কোনো নারী যাত্রীকে আলতো করে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। বিশেষ করে মেয়েদের সিটের আশপাশ থেকে সহজে কেউ পেছনে আসতে চায় না কেন, এটাও দুর্বোধ্য। আর কোনো ঘটনা ঘটে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষকামী পুরষ পার পেয়ে যায় তার চারপাশের ধর্ষকামী পুরুষের কল্যাণেই।
ধর্ষণের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে ধর্ষকের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তাবৎ পুরুষদের দুই ভাগে ভাগ করা হলে ধর্ষকদের সংখ্যা বেশি হতে বাধ্য। এখন আমি বা আপনারা কোন পক্ষে দাঁড়াব সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। ধর্ষণের প্রারম্ভিক কোনো উস্কানিমূলক কর্মকা- চোখের সামনে দেখেও না দেখার ভান করলে তা শেষ পর্যন্ত একটি নির্যাতনের ঘটনায় পরিণত হতে বাধ্য। এ ধরনের ঘটনা ঘটুক, তাতে মনে হয় আমাদের কিছুই যায় আসে না। এ কারণেই বনানীর হোটেলে ধর্ষকদের পিতা বা অভিভাবকরা তাদের ধর্ষক ছেলেদের পক্ষেই সাফাই গাইতে পারেন, নির্যাতিতার পক্ষে নয়। নির্যাতিতাদের মনে অবস্থা আদতেই আমরা কেউ উপলব্ধি করতে পারছি না। একজন মানুষ হিসেবে আমি যদি আমার ধর্ষক ছেলেকে রক্ষা করার জন্য যা যা দরকার তা করি তাহলে আমাদের মেয়েদের নির্যাতিতা হতে অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না। একজন ভাই, একজন অভিভাবক, একজন পিতা বা একজন স্বামী যেকোনো রূপেই একজন পুরুষ হিসেবে নিজের অবস্থান নিয়ে কি প্রশ্ন তোলার সময় আসেনি? আমরা আসলে কোন পক্ষে, ধর্ষকের নাকি সহযোগির?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান