সাঈদির রিভিউ শুনানীতে আপিল বিভাগ সাক্ষ্য প্রমাণের (দুর্বলতায়) ফাঁসি দিইনি,… আমরা এখানে কসাই না, যে বলেই ইয়ে করে দেব
এস এম নূর মোহাম্মদ : আমৃত্য কারাদ-প্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রিভিউ শুনানিতে আপিল বিভাগ বলেছেন, সাক্ষ্য প্রমাণে আমরা মেজরিটি ফাঁসি দিইনি। গতকাল রোববার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চে অ্যাটর্নি জেনারেল সাঈদীর সাজা পরিবর্তন করে ফাঁসির আবেদন জানালে আদালত এ কথা বলেন।
গতকাল সাঈদীর মামলাটি আপিল বিভাগের কার্য তালিকায় ৩০ নম্বর ক্রমিকে ছিল। বিরতির পর মামলাটি শুনানির জন্য আসলে শুরুতেই দাঁড়ান অ্যাটর্নি জেনারেল। এ সময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি কেন। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি তো রিভিউ চেয়েছি। প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা মি. হোসেনের (খন্দকার মাহবুব হোসেন) বিষয়। তিনি তো খালাস চেয়েছেন। আপনি তো ফাঁসি চেয়েছেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল হ্যাঁ সূচক জবাব দেন।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, দ- তো হয়েছে। আপনি চাচ্ছেন ফাঁসি। অ্যাকুইটাল (খালাস) যদি হয়ে যায় ফাঁসি দিতে পারবো তো? পরে সাঈদীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন দাঁড়ান। তখন প্রধান বিচারপতি তাকে প্রশ্ন করেন, কয়টা অভিযোগে যাবজ্জীবন? কয়টা অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করতে চান? জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, তিনটি। ১০, ১৬, ১৯ নম্বর অভিযোগ।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা শুনবো। তবে ফ্যাক্টসে গেলে হবে না। ল’এর ওপর বলতে হবে। এ সময় খন্দকার মাহবুব হোসেন লিখিত যুক্তি জমা দিলে আদালত তাকে ধন্যবাদ জানান।
পরে খন্দকার মাহবুব হোসেন চার্জ-১০ এ যুক্তিতর্ক শুরু করার কিছু সময় পর প্রধান বিচারপতি বলেন, এখানে তো বললেন না যে সাক্ষীরা জীবিত আছে। ৪৩ বছরে রাজনৈতিক মেরুকরণ, আত্মীয়তা, বিয়ে-টিয়ে করে অনেক পরিবর্তন চলে আসছে। বুড়িগঙ্গার পানি গড়িয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে বাষ্প হয়ে চেরাপুঞ্জি, হিমালয়ে গিয়ে সেখানে বরফ গলে প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন তার শুনানি অব্যাহত রাখলে প্রধান বিচারপতি বলেন, হাইকোর্ট ভুল করতে পারে। আমরা হায়েস্ট কোর্ট তো। মোটামুটি এটা দেখেছি। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সে সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। এতে আদালত বলেন, ঘটনাগুলো তো ঘটেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে তখন ওয়াজ করার জন্য আপনি পরিবার-পরিজন নিয়ে যশোরে গিয়েছিলেন সে যুক্তি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য না। সাধারণত ওয়াজ হয় ধানকাটার পর শীতকালে। আপনি বলেছেন, মে মাসে। মে মাসে তো বর্ষাকাল। এখনো কি এই সময়ে ওয়াজ হয়? এখন তো অনেক উন্নতি হয়েছে, তারপরও কি মার্চ-এপ্রিল কিংবা মে মাসে ওয়াজ হয়?
জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, হয়। একটা বৃহৎ পরিসরে, আরেকটি ছোট পরিসরে হয়। তাছাড়া সাঈদী লেখাপড়া করার জন্যই পরিবার নিয়ে সেখানে ঘর ভাড়া করে থাকতেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, না, হয় না। আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। আপনি তো পেশাদার বক্তা। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি ছিলেন না। একজন শুধু ওয়াজ করার জন্য বাসা ভাড়া করে থাকবে? আপনি বিবাহিত, বউ-বাচ্চা আছে। এটা অগ্রহণযোগ্য।
খন্দকার মাহবুব বলেন, আমি তো সাঈদী হলাম সেদিন। মামলা-টামলা হওয়ার পরে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি তো তখন দেলাওয়ার হোসেন শিকদার ছিলেন। বলা হচ্ছে, আমাদের সন্দেহ লাগছে, মে মাসের পর আপনি (সাঈদী) এলাকাতে যান, এটা আমাদের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি বলেন, অনেক মামলাতেই ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। খেয়াল করে দেখবেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে আমরা ফাঁসি দিইনি। অনেক বিষয় বিবেচনা করে সাজা কমানো হয়েছে।
এ পর্যায়ে খন্দকার মাহবুব বলেন, এজন্যই তো আমরা সাহস করে এসেছি। আরও কিছু করা যায় কি না। এরপর প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চান রাষ্ট্রপক্ষ শুনানি করবে কি না। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি তো ফাঁসি চাই। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ ব্যবস্থা ছিল না। আমরা আপিল বিভাগ রায় দিয়ে সেটা দিয়েছি ন্যায়বিচারের স্বার্থে। তাই আমরা চাই না বিচার বিভাগ প্রহসনের হোক।
তিনি বলেন, রিভিউ হলেই যে তা খারিজ হয়ে যাবে এমনটা নয়। এ মামলায় আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণসহ সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছি। এ রায় দেওয়ার আগে আমরা বিচারপতিরা পর্যালোচনা বৈঠক করেছি। এরপর সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আপনারা দেখেছেন এ মামলায় দ্বিধাবিভক্ত রায় হয়েছে। আর আপিল বিভাগ শুনানির পর কাউকে সাজা দেয়, রিভিউতে সেটা পরিবর্তন খুবই দুষ্প্রাপ্য। আপনি বরং এ সাজা কিভাবে বহাল থাকে তারপক্ষে যুক্তি দেখান।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে সাঈদী সহযোগী। কিন্তু সে তো হুকুমদাতা। পরে প্রধান বিচারপতি বলেন, মি. অ্যাটর্নি জেনারেল, ক্রিমিনাল জুরিস প্রুডেন্সটা আপনি পড়বেন। ১০৯টা একটু দেখে আসবেন। আমরা এখানে কসাই না। বললেই ইয়ে করে দেব। পরে আদালত সোমবার পর্যন্ত শুনানি মূলতবি করেন।