গণপরিবহনে নৈরাজ্য : সমাধান কী?
অ্যাড. তৈমূর আলম খন্দকার
গণপরিবহনে নৈরাজ্য, এ কোনো নতুন কথা নয়। নৈরাজ্য বলতে পরিবহন জগতের বিশৃঙ্খলা, মনোপলী ব্যবসা, আইন নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং মানুষ হত্যার একচেটিয়া লাইসেন্সধারী সেক্টর বললেও ভুল বলা হবে না। সরকার আসে, সরকার যায় কিন্তু গণপরিবহনের দাপট আর কমে না। কারণ তারা সবসময়ই সরকারি দল। যখন যে দল ক্ষমতায় সে দলের নেতাদের সামনে রেখেই পরিবহন মালিকেরা তা-ব চালায়। সময়ে সময়ে এদেশে যারা এমপি/মন্ত্রী হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কর্তাব্যক্তি রয়েছেন যারা পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, স্বনামে বা বেনামে।
পরিবহন থেকে প্রতিদিন যে চাঁদা ওঠে তার একটি অংশ বাটোয়ারা হয়। প্রতি টার্মিনাল, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় অতিক্রম করার চাঁদাবাজি ছাড়াও গণপরিবহনের নেতারা নিয়মিত চাঁদা পেয়ে থাকে। যে সকল প্রাইভেট মাইক্রোবাস যাত্রীদের জন্য ভাড়ায় খাটে তাদেরকেও একটি নির্দিষ্ট চাঁদা পুলিশ ও নেতাদের পরিশোধ করতে হয়। বিআরটিএ রুট পারমিট দিলেও পরিবহন নেতাদের মোটা অংকের টাকা না দিলে সে রুটে বাস চালানো যাবে না এটা ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের মতো যেন একটি অলিখিত আইন যাহা বাধ্যতামূলক অর্থাৎ গঅঘউঙঞঅজণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেপরোয়া ট্রাককে সরকার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। কারণ সরকার যতই নিষেধাজ্ঞা প্রদান করুক না কেন ঘুষ বাণিজ্যের কারণে তা বিফলে যায়। ঘুষের বিনিময়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ট্রাক চালকদের টোকেন দেওয়া হয়, যেমনÑ এপ্রিল মাসে যদি বাঘের ছবির টোকেন দেওয়া হয় তবে মে মাসের জন্য দেওয়া হবে হরিণের ছবি সম্মিলিত টোকেন। উক্ত টোকেন প্রতি মাসেই পরিবর্তন হয় যা পুলিশের নির্ধারিত কর্মকর্তাদের নিকট থেকে ট্রাক মালিকরা ক্রয় করে, ফলে ফিটনেস, ব্লুবুক, প্রভৃতি সঠিক না থাকলেও অনায়াসে ট্রাক এক জেলা থেকে অন্য জেলায় সহজেই চলাচল করতে পারে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অপপরফবহঃ জবংবধৎপয ঈবহঃবৎ-এর জরিপে দেখা যায় যে, দেশে প্রতি বৎসর ১২ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার কারণে মারা যায়, আহত হয় ৩৫ হাজার মানুষ। জাতিসংঘের প্রতিবেদন মোতাবেক বাংলাদেশের বার্ষিক আরবান গ্রোথ হচ্ছে ৪%, আর মোটর ভেহিকেল গ্রোথ হচ্ছে ৮% অর্থাৎ দ্বিগুণ। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, ২০১৬ সালে ৬,৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটায় মৃত্যু হয়েছে ৮,৬৪২ জন। যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান সরকার করেনি। দুর্ঘটনায় নিহত হলে বিআরটিসি থেকে ২০,০০০/- (বিশ হাজার) টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান করা হয়েছিল যা সম্পূর্ণ অপ্রতুল। যানজট সমস্যা, কিন্তু তা ঝুংঃবস খড়ংং এবং কিছুটা কৃত্রিম যা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অবহেলার কারণে সংগঠিত হচ্ছে। আমাদের দেশে দুর্ঘটনার কি কি কারণে হয় তা চিহ্নিত করা দরকার। বিআরটিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন গবেষণামূলক সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়ে যে কারণগুলো উপলব্ধি করেছি তা নিম্নে তুলে ধরা হলো। ১. চালকদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং-এর অভাব, ২. চালকদেরশারীরিক ফিটনেসের অভাব, ৩. একই চালক কর্তৃক একাধারে যাত্রাতিরিক্ত সময় গাড়ি চালানো, ৪. ক্রটিপূর্ণ যানবাহন চালানো, ৫. গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে মালিকদের উদাসীনতা, ৬. রোড ম্যানেজমেন্টে কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতা, ৭. রাস্তায় চলাচলে যাত্রীদের অসচেনতা, ৮. দুর্ঘটনায় কবলিত যাত্রীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা অপ্রতুল,
চালকদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং-এর অভাব: আমাদের দেশের অধিকাংশ পেশাদার চালক অসচ্ছল পরিবার থেকে আগত। তারা ‘ওস্তাদ’ ধরে গাড়ি চালানোর সহযোগিতা করতে করতে ওস্তাদ অর্থাৎ ড্রাইভারে পরিণত হয়। সাংকেতিক চিহ্ন, দ্বায়িত্ব জ্ঞান, অটোমোবাইলের প্রাথমিক জ্ঞান, স্পিড লিমিট প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকে না বা শিক্ষাগ্রহণের ধার ধারে না। বিআরটিসির ট্রেনিং স্কুল ছাড়া দেশে এ জাতীয় কোনো বৈধ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। ২০০২-২০০৬ পর্যন্ত বিআরটিসি দেশব্যাপী ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ১৮টি উন্নীত করে যার অধিকাংশ এখন বন্ধ। বিআরটিএ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দফতর বিধায় এখান থেকে ভুয়া লাইসেন্স গ্রহণ করা কোনো কঠিন বিষয় নহে। একটি জাহাজের নাবিক, বিমানের ক্যাপটেন এবং একটি বাস ড্রাইভারের সঙ্গে তফাৎ হলো এই যে, বিমান আকাশে ওড়ে, জাহাজ পানিতে চলে, বাস মাটির উপরে রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। কিন্তু যাত্রীর জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে কারও চেয়ে কারও দায়িত্ববোধ কম নয়। যাত্রীদের ও পথচারীদের নিরাপত্তার প্রশ্নে ড্রাইভারদের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলার পারিপার্শ্বিক সচেতনা ও ট্রেনিং হওয়ার ব্যবস্থা অপ্রতুল। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর এমনকি থাইল্যান্ডেও দেখেছি যে, সে দেশের ড্রাইভারগণ ড্রাইভিং অবস্থায় মোবাইলে কথা বলে না। ২০১৩ সনের ডিসেম্বরে ক্যামব্রিজ শহর থেকে ইস্ট লন্ডনে লন্ডন বিএনপির সভাপতি জনাব আ. মালেক নিজেই গাড়ি চালিয়ে স্ত্রীসহ আমাকে লিফ্ট দেওয়ার সময় মোবাইলে কথা বলার কারণে তাকে ক্যামেরায় শনাক্ত করে জরিমানা করা হয়। সে ধরনের প্রযুক্তি আমাদের দেশে গড়ে না উঠলে দায়িত্ব সচেতনার দিক দিয়ে ড্রাইভিং অবস্থায় মোবাইলে কথা বলা সম্পর্কে সরকার বা জনগণ বা ড্রাইভার সমাজ কোনো অপরাধ মনে করে না। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে আমাদের দেশে যে শব্দ দূষণ হওয়ায় প্রতিনিয়ত মানুষ ‘বধির’ বা আংশিক বধির রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তা ড্রাইভার ও গাড়ির মালিক সমাজ উপলব্ধি করতে পারে না। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ থাকলে এর অপব্যবহার সম্পর্কে সচেতনা সৃষ্টি হয়নি।
২। চালকদের শারীরিক ফিটনেসের অভাব: পেশাদার চালক যাদের উপর যাত্রীদের জানমালের নিরাপত্তা নির্ভর করে তাদের শারিরিক ফিটনেস অত্যন্ত জরুরি। অনেক মানুষ রয়েছে যারা ঈঙখঙটজ ইখওঘউ অর্থাৎ কোনো কোনো রং চোখে দেখে না। বিষয়টি অত্যন্ত নির্মম হলেও সত্যি যে, পেশাদার চালকগণ তীব্র যানজট ও রৌদ্র বৃষ্টির মধ্যে দূরপাল্লার গাড়ি চালিয়ে একজন সাধারণ জীবিকার মানুষের চেয়ে বেশি কর্ম অক্ষম হয়ে পড়ে। তারপরও জীবন জীবিকার তাগিদে গাড়ি ড্রাইভ করতে হয়। (চলবে-০১)
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন, এবং গণপরিবহন পরিচালনায় উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
ঃধরসঁৎধষধসশযধহফধশবৎ@মসধরষ.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান