অপসারিত হচ্ছে আলো, প্রতিস্থাপিত হচ্ছে অন্ধকার
কাকন রেজা
সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য বিষয়ক ‘মেলোড্রামা’ নিয়ে নানা কথকতা গণ ও সামাজিক মাধ্যমকে মুখর করে রেখেছে। এর রেশ হয়তো আরও কদিন চলবে। সঙ্গে যোগ হয়েছে এক বাঙাল নায়িকার আইটেম নাচ নিয়ে যুক্তিচারিতা। তবে হালে খুব মজা পেয়েছি কারও কারও সুপ্রিম কোর্টের ‘মূর্তি’কে জায়েজ করতে বিভিন্ন ইসলামি দেশের স্মরণাপন্ন হতে দেখে। এমনকি পাকিস্তান সঙ্গে তুরস্ক পর্যন্ত। এসব দেশেও যে ‘ভাস্কর্য’ রয়েছে তা প্রমাণের জন্য তাদের কী ভয়াবহ রকমের কসরত।
এমন কসরতে একজনকে দেখলাম পাকিস্তানের একটি মসজিদের ছবি দিতে। লাহোরের সেই মসজিদটির পার্শ্বে ‘মা মেরি’র একটি ভাস্কর্য রয়েছে। সেই ‘মা মেরি’কে উপলক্ষ্য করে তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন, পাকিস্তানেও মসজিদের কাছে যদি ভাস্কর্য থাকে, তবে বাংলাদেশে জাস্টিশিয়া নয় কেন? যুক্তি, প্রমাণ তো তাই বলে। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন এসে যায়, তবে কি পাকিস্তান ধর্মনিরপেক্ষ? না হলে তো, মসজিদের পার্শ্বে ‘মা মেরি’র মূর্তি বা ভাস্কর্য থাকার কথা নয়। হায়রে স্খলন! বাংলাদেশের ‘জাস্টিশিয়া’কে জাস্টিফাই করতে পাকিস্তানের মসজিদ সংলগ্ন ‘মা মেরি’কে নিয়ে টানাহ্যাচরা। মসজিদের সামনে না হয় ওই ভাস্কর্য রয়েছেই, না হয় সেটা ‘মা মেরি’রই, তাই বলে তাকে নিয়ে এমন প্রচারণা কেন? উনারা কী বাংলাদেশের মতোন পাকিস্তানকেও ‘সেক্যুলার’ বানানোর দায়িত্ব নিলেন? উত্তর নেই জানা।
ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে ঘুরছে ‘ভাস্কর্য’ কাহিনী। কোন মুসলিম দেশে ‘ভাস্কর্য’ রয়েছে, কোন মসজিদের সামনে রয়েছে, কার রয়েছে, কেন রয়েছে এসবের সবিস্তার বর্ণনা। আর এই বর্ণনার অন্যতম অধ্যায় হচ্ছে ‘তুরস্ক’ এবং তার প্রেসিডেন্ট ‘এরদোগান’। সেই তুরস্ক, সেই এরদোগান, কদিন আগেও যে রাষ্ট্র ও যিনি ধর্মান্ধ বলে আখ্যায়িত হয়েছেন তাদেরই সেই ওয়ালে আজ ‘তুরস্ক কাহিনী’ শোভা পাচ্ছে। আজকে তাদের ফিরতে দেখছি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র আর ধর্মান্ধ সেই প্রেসিডেন্টের কাছে! যেন এরদোগান বললেই ‘জাস্টিশিয়া’ জাস্টিফায়েড, আবার ফিরে পাওয়া ‘হৃত রাজ্যপাঠ’। নীতি ও আদর্শের কী স্খলন! কী বলছেন, কেন বলছেন তা নিজেই ধরতে পারছেন না। নিজের সঙ্গে নিজের ‘কনফ্লিক্ট’ নিজেরই অজানা থেকে যাচ্ছে। কিংবা জেনেই ‘কনফ্লিক্ট’ মেনে নিয়েই হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য নীতিহীন প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টার নামই সুবিধাবাদ। সুবিধাবাদের কোনো নীতি-আদর্শ নেই, ধর্ম-দর্শন নেই। সুবিধাবাদীদের প্রাপ্তিকাক্সক্ষা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। আমাদের যাতনার বিষয় এবং লজ্জারও, এমন কিছু সুবিধাবাদীদের কাছ থেকেই আমাদের শুনতে হয় নীতি-আদর্শের বয়ান! এমনসব মানুষেরাই আজকাল দেশপ্রেমের দীক্ষাগুরু। সেল্যুকাস!
বারবার বলি, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়ে ভয়ংকর। কারণ নির্জলা মিথ্যা খুব একটা চলে না, তার সঙ্গে সত্যের মিশেল দিলে সেই মিথ্যা হয়ে উঠে গ্ল্যামারাস। আর গ্ল্যামার সবাই চায়, খায়। অর্ধসত্য যেমন ভয়াবহ আমাদের দেশের অর্ধশিক্ষিত সুবিধাবাদী দীক্ষাগুরুরা তার চেয়েও ভয়াবহ। (ঠিক ভারতের ‘ওম স্বামী’র মতোন। অন্তত ‘নুসরাত ফারিয়া’র আইটেম নাচের ঘটনায়।) এদের সুবিধাবাদীতার জন্যেই এদেশে সঠিকভাবে না প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে ধর্ম কিংবা ‘সেক্যুলারিজমে’র ভালো দিকগুলো। এরা নিজেদের স্বার্থে সব জগার খিঁচুরি বানিয়ে ফেলেছেন।
সুবিধাবাদের বাহাসে হারিয়ে যাচ্ছে মূল বিষয়সমূহ অথচ যা ফোকাসড হবার কথা ছিল, প্রয়োজন ছিল। এখানে অপসারণের খেলায় অপসারিত হচ্ছে আলো, প্রতিস্থাপনের খেলায় প্রতিস্থাপিত হচ্ছে অন্ধকার। আর আলো আঁধারির এই খেলায় বিনা প্রশ্নে লোপাট হচ্ছে এমন কিছু বিষয় যার কাছে ‘জাস্টিশিয়া’ থাকল কি থাকল না সে প্রশ্ন নেহাতই বালখিল্য।
পুনশ্চ: সুবিধাবাদের হাতে আলো থাকলে তা আমজনতার কোনো কাজেই আসে না, সেই আলো শুধু প্রজ্জ্বলিত হয় সুবিধাবাদীদের ‘ভল্টে’র অন্ধকার দূর করতে। আবারও বলছি এখন এখানে অপসারিত হচ্ছে আলো, প্রতিস্থাপিত হচ্ছে অন্ধকার, আর আমরা ক্রমেই পরিণত হচ্ছি আঁধার পথের যাত্রিতে।
ফুটনোট: ‘আমাদের দেশে যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশ ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে নিজেদের দাবি করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনের ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।’ উদ্ধৃতিটা আহমদ ছফা থেকে। ভুল বুঝবেন না, যারা মানুষকে জেতানোর জন্য ভাস্কর্য কাহিনী প্রচার করছেন, তাদের জন্য শুভকামনা। কিন্তু যারা নিজেরা জেতার জন্য কাহিনী প্রচার করছেন তাদের জন্য রয়েছেন আহমদ ছফা এবং তার উদ্ধৃতি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান