জাতীয় ঐক্য ডুমুরের ফুল, না বর্ষার কদম?
অজয় দাশগুপ্ত
জাতীয় ঐক্যের ডাক নিয়ে দেশে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। অভিনব বিষয় বৈকি। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের ডাক বা দরকার পড়ল এতদিনে? যখন দেশ, জাতির সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই, যখন সন্ত্রাসের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সংস্করণও আমরা শিখে ফেলেছি, তখন এই ডাকের কথা মনে পড়ল রাজনীতিবিদদের? অনেক বিষয় বিলম্বে হলেও মঙ্গলের। যদি তা সার্বিককল্যাণের পথ খুলে দিতে পারে।
কিন্তু জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর কি দলীয় ঐক্য আছে? বিশেষত, বিএনপি যখন এ নিয়ে সরকারকে দোষারোপ করছে তাদের কাছে প্রশ্ন রাখি, দল বাদ দিন আপনারা নিজেরা কি নাজমুল হুদাকে বিশ্বাস করেন? তাকে রাখবেন জাতীয় ঐক্যে? তার কথা বাদ। মওদুদ আহমেদের ব্যাপারে আপনারা সংশয়হীন? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনারা তাকে একশ পার্সেন্ট বিশ্বাস করেন? আওয়ামী লীগারদের বলি, আপনারা আসলে মেনন-ইনুর সববিষয় মানেন? আছে আপনাদের মহাজোটের ঐক্য? গদিতে আছেন বলে অনেক অনৈক্য চাপা পড়ে আছে। সে পাষাণ চাপা অনৈক্য পুরাণের অহল্যার মতো যেদিন প্রাণ পাবে দল তো দল ঘরে ঘরে ঐক্য থাকে কিনা দেখে নিবেন। যদি থাকত একতরফা নির্বাচনে বিদ্রোহী নামধারী নিজেদের দলের লোকদের ভিতর লড়াই চলত? শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া না থাকলে বা কোনো বিষয়ে নজর না দিলে মহল্লার কমিটি পর্যন্ত হয় না, সে জাতিতে আবার ঐক্য?
আসুন বৃহত্তর পরিবেশে। নরেন্দ্র মোদিরা পাওয়ারে এসেছেন গান্ধী বিরোধিতা করে। তারা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে বীর মনে করেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী হবার পর গান্ধীর সমাধিতে বা মূর্তির সামনে নতজানু মোদি হাতে ফুল নেওয়া মোদির অজস্র ছবি দেখতে পাবেন। জাতীয় দিবসে বা বিশেষ দিনে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অনৈক্য নেই তাদের ভিতর। চলুন পাকিস্তানে। আমাদের যেসব সুশীল দেশপ্রেমিকরা এদেশের নাম শুনলে জ্বলে ওঠেন তাদের বলি, আপনারা বাংলাদেশে শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাদ দিয়ে রোববারে করতে পারবেন? পাকিস্তান পেরেছে। পারবেন তাদের মতো জাতীয় ঐক্যে মাদ্রাসা বন্ধ করতে? গত ফেব্রুয়ারিতে আমি লাহোর বর্ডারে দেখেছি তাদের দেশপ্রেম কতটা তীব্র। তাদের সবার মাথার ওপর জিন্নাহর ছবি। কোন সরকার এ যাবত জিন্নাহকে কায়েদে আজম মানতে অস্বীকার করেছে? একে বলে জাতীয় ঐক্য। আছে আমাদের?
আমরা ভারত বা পাকিস্তানের মতো চুক্তিতে স্বাধীন হওয়া দেশ না। রক্ত, সংগ্রাম, ইজ্জতহানিতে পাওয়া দেশ আমাদের। তারপরও আমরা এককভাবে বঙ্গবন্ধুকে মানি না। আমরা কোনো দলের কাউকে মানি না। অথচ এখন বলছি জাতীয় ঐক্য চাই। জাতীয় ঐক্যের মানে কয়েকজন নেতা মিলে বৈঠক করা? তারপর মিডিয়ায় হাসি হাসি মুখে বলা সব ঠিক হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি বৈঠক করলেই যদি সমস্যার সমাধান হয় তাহলে তো মানতে হবে, এ দু’দলের লোকরাই সন্তপাস ও জঙ্গিবাদে ব্যস্ত। আর যদি না হয় তাহলে ঐক্য হতে হবে পুরো দেশের। সেটা কিভাবে সম্ভব। আমি গান শুনলে আপনি বলবেন হারাম। আমি নাচলে আপনি বলবেন বেহায়াপনা, আমি কাঁদলে আপনি বলবেন ভ-, আমি খোদা হাফেজ বললে আপনি বলবেন হয়নি। আমি ইসলাম বললে আপনি বলবেন রাজাকার, আমি সংস্কৃতি বললে আপনি বলবেন হিন্দু। এভাবে ঐক্য হয়?
ঐক্য বা বন্ধনের একটাই পথ। জীবনমুখি মানুষদের সংস্কৃতি ও আনন্দের সঙ্গে যোগ করে নেওয়া। এককালে ছিল। ছিল বলেই মানুষ একজনকে মরতে দেখলে এককাতারে দাঁড়িয়ে যেত। সভ্যতা, মিডিয়া, সুবিধাবাদ অপ্রস্তুত বাংলাদেশিদের স্বার্থপর অন্ধ আর জঙ্গি করে তুলেছে। এখনও জঙ্গিবাদ দুর্বল। একবার আফগানিস্তানের আদলে নিতে পারলে আর কোনোকালে আগের জায়গায় ফেরা যাবে না। ইরান, তুর্কি, আফগানিস্তান, পাকিস্তান তার বড় উদাহরণ। তাই চাই বৈকি। জাতীয় ঐক্য চাই। ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে বৈঠক করে দেখুন কি হয়? ওরা আছে, ওদের অস্বীকার করবেন কিভাবে? নির্মূল, উচ্ছেদ বা শেষ করার কথা বাদ দিন। জাতীয় সমঝোতার শেষ সুতোটা দিয়ে সবাইকে জড়িয়ে রাখুন। যারা গেছে তারা গেছে, যারা আছে যারা এদেশে থাকে বাইরে বাংলাদেশি হিসেবে বাস করে সবাই আমরা। ওরা তারা বলে কিছু থাকতে পারবে না। একত্রে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর বঙ্গবন্ধুকে না মানার জাতিতে জাতীয় ঐক্য কঠিন। তবু সবাই বাঁচতে চেষ্টা করা গেলে হয়তো পথ খুলে যাবে। তখন তা ডুমুরের ফুল না হয়ে এই বর্ষায় কদম হয়েও ধরা দিতে পারে।
লেখক : সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন